শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে পরীক্ষার খড়গ

শিক্ষার হালচাল - ১৪

আকতারুজ্জামান

একের পর এক পাবলিক পরীক্ষার খড়গ চাপানো হয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে। লেখাপড়া শুরু করার মাত্র ১২টি শিক্ষা বছরের মধ্যে প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষা এবং উচ্চ মাধ্যমিকে পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। অনেক দেশে উচ্চ মাধ্যমিকের আগে পাবলিক পরীক্ষার কোনো আয়োজন না থাকলেও এ দেশে উচ্চ মাধ্যমিকের আগেই তিনটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা পার করে আসতে হয় শিক্ষার্থীদের। সব মিলিয়ে পাবলিক পরীক্ষার চাপে পিষ্ট হয় ছাত্রছাত্রীরা। এ ছাড়া প্রতি বছর প্রতি ক্লাসে ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার আয়োজন তো রয়েছেই! আর মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে পাবলিক পরীক্ষার আগে ছাত্রছাত্রীদের বসতে হয় ‘টেস্ট বা নির্বাচনী’ পরীক্ষায়। একের পর এক এসব পরীক্ষায় নাকাল আর নাস্তানাবুদ হয় ছাত্রছাত্রীরা। শিক্ষা আর আনন্দময় হয়ে ওঠে না শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু তাদের দিকে নজর দেওয়ার যেন কেউই নেই।

যদিও সরকার বলছে, পঞ্চম শ্রেণিতে নেওয়া প্রাথমিক সমাপনী কোনো পাবলিক পরীক্ষা নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে ঘটা করে করা হচ্ছে এ পরীক্ষার আয়োজন। সরকারের মন্ত্রীরা পরীক্ষার আয়োজন, ফল প্রকাশ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করায় এ পরীক্ষাকে পাবলিক পরীক্ষা হিসেবেই নিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। কেন্দ্রীয়ভাবে এ পরীক্ষা দিতে গিয়ে শৈশবেই শিশু শিক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষার ভীতি বাসা বাঁধছে। ফলে তাদের মধ্যে আনন্দময় শিক্ষা আর কাজ করে না। কোমলমতি বাচ্চাদের এসব পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকদেরও আশঙ্কা উদ্বেগের কমতি থাকে না। তারা বরাবরই অল্প বয়সের এই ছাত্রছাত্রীদের এ সমাপনী পরীক্ষার বিরোধিতা করে আসছেন। প্রাথমিক সমাপনীর পর মাত্র তিন বছরের মাথায় কৈশোরে এসে শিক্ষার্থীদের বসতে হচ্ছে আরেক পাবলিক পরীক্ষায়। স্কুলে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও মাদ্রাসায় জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে তাদের। সরকার এ পরীক্ষাকে পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। পরীক্ষার ফলাফল বর্তমানে জিপিএ (গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ) সিস্টেমে দেওয়া হচ্ছে। সন্তানদের ভালো ফলাফলের জন্য অভিভাবকদের উদ্বেগের শেষ থাকে না। শ্রেণিকক্ষে পাঠের বাইরে তাদের শরণাপন্ন হতে হয় কোচিং আর টিউটরের কাছে। দেশের শিক্ষাবিদরা বরাবরই এসব পাবলিক পরীক্ষার বিরোধিতা করে এলেও সরকার কোনো গা করেনি। তাই থেমে থাকে না এ পাবলিক পরীক্ষা উপলক্ষে কিশোর-কিশোরীদের উৎকণ্ঠা। এসব পরীক্ষায় ভালো করতে গিয়েও ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা শরণাপন্ন হয় প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে। এ পাবলিক পরীক্ষার মাত্র দুই বছরের মাথায় ছাত্রছাত্রীদের আরেক পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। এ পরীক্ষার নাম মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) বা সমমান পরীক্ষা। এ পরীক্ষার ফলাফল প্রভাব ফেলে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে। তাই এ পরীক্ষায় ভালো করতে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন একাডেমিক কোচিংয়ের দ্বারস্থ হয়। উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এইচএসসি) বা সমমান পরীক্ষা হচ্ছে উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠে প্রবেশের আগের পরীক্ষা। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল এবং একটি পরীক্ষার মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় ছাত্রছাত্রীরা। তাই কলেজের এ পরীক্ষার পর ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে শরণাপন্ন হয় নানা কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউটরের। শুরু হয় ছাত্রছাত্রীদের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাকে পুঁজি করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ব্যবসায় লিপ্ত হয় দেশের কোচিং সেন্টারগুলো। দেশের শিক্ষাবিদরা বলছেন, অনেক দেশে উচ্চ মাধ্যমিকের আগে পাবলিক পরীক্ষার কোনো আয়োজন নেই। অথচ এ দেশে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপে একদিকে যেমন ছাত্রছাত্রীদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠায় থাকছেন অভিভাবকরাও। এসব অতিরিক্ত পাবলিক পরীক্ষাকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ আখ্যা দিয়ে তা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

সর্বশেষ খবর