শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

শত আদিবাসী নারীর জীবন বদল পারলারে

মাসুদ হাসান বাদল, শেরপুর

শত আদিবাসী নারীর জীবন বদল পারলারে

সাজগোজ নারীকে করে তোলে আকর্ষণীয় ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। বাংলার ঐতিহ্যকে ঘিরে ১২ মাসের ১৩ পার্বণসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠান ঘিরে নারীর সাজগোজ এখন নিত্যদিনের জীবনের অংশ। বর্ষবরণ, বসন্ত, হেমন্ত, নবান্ন, বর্ষাবরণ, ভালোবাসা দিবস, বিয়ে, গায়ে হলুদ, ঈদ, পূজায় নারীর সাজ অত্যাবশ্যক। আর নারীকে পরিপাটি করে সাজাতে শেরপুর শহরের পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে বিউটি পারলার। নারীর সাজগোজের চাহিদা মেটাতে সীমান্ত জেলা শেরপুরের       অন্তত দেড় হাজার নৃ-গোষ্ঠী নারী কাজ করে বদলে দিয়েছে তাদের জীবন-জীবিকা। এই জেলার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও সদর উপজেলা মিলিয়ে হাজার পঁয়ত্রিশ আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। মোট জনসখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। মাতৃতান্ত্রিক পরিবার-সংবলিত গারো, কোচ, হাজং, ঢালু, বানাই ও বর্মণসহ ছয়টি নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গারো সম্প্রদায়। পরিবার মাতৃতান্ত্রিক হওয়ায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এসব নারী যুগ যুগ ধরে পিঠে তাদের সন্তানদের ঝুলিয়ে খেতে কাজ করা, পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ, বাজার করাসহ প্রায় সব কাজ করে থাকেন। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। গতানুগতিক জীবনে পিছিয়ে পড়া এসব নারী পেশা হিসেবে বিউটি পারলারকে বেছে নিয়ে আয় করে পরিবারের লক্ষ্মী বনে গেছেন। এখন তারা পাতা কুড়ানো, কাদা-মাটি ছেড়ে পারলারের বদৌলতে শহুরে জীবনের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছেন। শেরপুর জেলার আদিবাসী সব বয়সী নারীর বিরাট একটা অংশ এখন পারলারের ব্যবসা ও এখানে শ্রম বিক্রি করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার মরিয়মনগর, বাঁকাকুড়া, ধানশাইল, বড় ও ছোট গজনী, ঝারনতলা; শ্রীবরদী উপজেলার বাবলাকোনা, হারিয়াভাঙ্গা, দিগলাকোনা, মালাকোচা, খারামোড়া, রাঙ্গাজান, চান্দাপাড়া; নালিতাবাড়ী উপজেলার গাছগড়া, বরুয়াজানি, কাঁকড়কান্দি, বেললৈ, হাতিবান্ধা, কালাকুমা, বাউরামারি, দাওধারা ও সদর উপজেলার দু-তিনটি অঞ্চলে আদিবাসীদের বসবাস। এখানকার নারীরাই প্রধানত বিউটি পারলারের সঙ্গে জড়িত। কেউ কেউ দেশের বিভিন্ন নামকরা বিউটি পারলারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ ও পরিবার চালাচ্ছেন। আবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো জায়গায় কেউ কেউ পারলারের মালিক হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ওই দুই মহানগরের পারসোনা, লিও, দিনা, জেমস, অনন্যা, ফেস, লসি, আল-সিরাজ, প্রজ্ঞা ইত্যাদি নামকরা সব পারলারে কেউ কেউ কাজ করছেন। ২০ বছর আগে আদিবাসী দু-চারজন নারী এ পেশায় জড়িত হন। প্রথম দিকে অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত বেকার নারীরা পারলারে কাজ শুরু করেন। তখন পরিবারের লোকজন এ পেশাটিকে ভালোভাবে নেয়নি। এই পেশায় জড়িতদের সমাজ একটু বাঁকা চোখে দেখত। তবু সবকিছু উপেক্ষা করে বিউটিশিয়ান পেশায় বাড়তে থাকে উপজাতি মেয়েদের সংখ্যা। এখন সীমান্তের শত শত নারী পারলার ব্যবসায় গিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পারলারে মাসিক পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন তারা। আর যারা বিউটি পারলারের মালিক, তাদের আয় মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। কয়েক বছর আগেও যাদের  চুলায় আগুন জ্বলত দিনের এক বা দুই বেলা, এখন ওই সব পরিবারে খাদ্যের কোনো ঘাটতি নেই। উপরন্তু অনেকেই স্বাবলম্বী। এখন শিক্ষিত অনেক আদিবাসী নারীই পারলারকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। উল্লিখিত গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই দুই থেকে পাঁচজন করে নারী পারলারের সঙ্গে জড়িত। তাদের অনেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেরাই পারলার খুলেছেন। তারা এলাকা থেকে মেয়েদের নিয়ে গিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছেন। জানা গেছে, পারলারে আয় করা টাকায় অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে, বেড়েছে শিক্ষার হার। তবে সামাজিক সমস্যার কথা স্বীকার করে পারলারে জড়িত অনেক নারী জানান, এ ধরনের কর্মক্ষেত্রে তারা নিরাপত্তাকেই বেশি গুরুত্ব দেন। যেখানে নিরাপত্তা বেশি থাকে উপজাতিরা সেখানে কাজ করতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন। ঢাকায় একটি পারলারে কাজ করেন লিছা চাম্বু গং ও তার বোন মাধুরী চাম্বু গং। লিছা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক আদিবাসী নারী পারলারে কাজ করছেন এবং তাদের পরিবারে সচ্ছলতা এনেছেন। শেরপুরের ঝিনাইগাতীর উপজাতি এক তরুণী চট্টগ্রামের নামকরা এক পারলারে কর্মরত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘পারলারে কাজ করে ভালো আয় করছি। সমাজ-পরিবার সবার কাছেই আমার মূল্য বেড়েছে।’ তিনি জানান, চট্টগ্রামের এমন কোনো পারলার নেই, যেখানে শেরপুরের চার-পাঁচজন আদিবাসী নারী কাজ করে না। ঢাকার একটি পারলারে কাজ করা তৃণা ম্রং (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমাদের আগে অনেক অভাব ছিল। আমি প্রায় ১০ বছর আগে ঢাকায় একটি পারলারে কাজ শুরু করি। বর্তমানে কাজ করছি দেশের প্রথম সারির একটি পারলারে। এখানে কাজ করে আমি বেশ ভালো আয় করছি। আমার জমানো টাকা দিয়ে বাড়িতে পাকা ঘর নির্মাণ করেছি।’

সর্বশেষ খবর