শুক্রবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ডান হাতে সালাম বাম হাতে অস্ত্র

মির্জা মেহেদী তমাল

ডান হাতে সালাম বাম হাতে অস্ত্র

মতিঝিলে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক সোহরাব হোসেন। অফিস শেষে পল্টন থেকে রিকশায় চড়ে মগবাজারের বাসায় ফিরছিলেন। রিকশাটি মৌচাক পর্যন্ত তখনো পৌঁছেনি। পথিমধ্যেই হঠাৎ এক ভদ্রলোক রিকশার কাছে এসেই তাড়াহুড়া করে চিৎকার করে বললেন, আরে বড়ভাই! স্লামালিকুম। সোহরাব হোসেন কিছু না বুঝেই ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে রিকশাচালকের পিঠে হাত দিলেন। রিকশাচালক রিকশার গতি কমিয়ে পাশেই থামলেন। সোহরাব পেছন ফিরে দেখলেন লোকটি রিকশার দিকে আসছে। সোহরাব হোসেন লোকটিকে চিনতে পারছেন না। তিনি দ্বিধায় পড়লেন। তাকেই কি সালাম দিয়েছে! নাকি অন্য কাউকে। ততক্ষণে ভদ্রলোকটি রিকশার সামনে। এসেই হাত বাড়িয়ে দিলেন। সোহরাব রিকশায় বসেই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। লোকটি খুব মার্জিতভাবে বললেন, ভাইয়া, আমাকে মনে হয় চিনতে পারছেন না। খুব কষ্ট পেলাম। সোহরাব এতে লজ্জা পান। বলেন, আরে না না, আসলে আমি অন্য চিন্তায় ছিলাম, মনে করতে কষ্ট হচ্ছে। লোকটি এবার বলেন, আমি আপনার আত্মীয়। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই আরও ৪/৫ যুবক রিকশার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারাও সালাম দেন সোহরাব হোসেনকে। তারা দেখতে খুবই স্মার্ট। কথা বলছেন সুন্দর করে। আশপাশে গাড়ি চলছে। লোকজন চলাফেরা করছে। কেউ কিছু বুঝতেই পারছে না। সেই যুবকদের একজন সোহরাবকে বলেন, ‘আচ্ছা ভাইয়া, আপনার আত্মীয়কে চিনতে পারলেন না। আচ্ছা ঠিক আছে। চেনার দরকার নেই। এই যে দেখুন আমার কোমরের দিকে। ইন করা শার্টের একটি জায়গায় উঁচু হয়ে আছে। তা দেখিয়ে যুবকটি বলে, এখানে পিস্তল গুঁজে রেখেছি। ৬ রাউন্ড গুলি আছে লোড করা। ট্রিগারে চাপ দিলে গুলি বের হয়। এটা যদি আপনার বুকে ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দেই, আপনার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হবে। মারা যাবেন। বউ বাচ্চা রাস্তায় পড়বে। তার চেয়ে এসবের প্রয়োজন নেই। আপনার পকেট হাতিয়ে যা পাব নিব। ডিস্টার্ব করলেই গুলি চালাব। এখানে কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না। চিৎকার করেও লাভ হবে না। এখানে আমরা আছি ৪/৫ জন। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও ১০ জন। ঠাণ্ডা মাথায় যুবকটি কথাগুলো বলে যান। এভাবে প্রকাশ্যে ঠাণ্ডা মাথায় খুনের কথা বলে যাচ্ছে যুবকটি। তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে সোহরাবের। তিনি আত্মসমপর্ণ করেন। বলেন, ভাই দেখুন আমার কাছে তেমন কোনো টাকা নেই। যুবকদের মধ্যে দুজন তার পকেট হাতানো শুরু করলেন। বিয়ের আংটি খুলে নিলেন। ঘড়ি মোবাইল সব ছিনিয়ে নিলেন। পকেট হাতিয়ে নয় হাজার টাকা পেল তারা। প্যান্টের চোরাই পকেটেও খুঁজে পেল তারা আরও পাঁচ হাজার টাকা। সব নিয়ে যুবকরা বললেন, ভাইয়া, আপনি চলে যান। পেছনে তাকাবেন, গুলি খাবেন। সোজা চলে যাবেন। চালাকি করলেই মারা পড়বেন। সোহরাব সেই রিকশাতে চড়েই চলতে শুরু করলেন। এরা ছদ্মবেশী ছিনতাইকারী চক্র। সালাম দিয়ে ছিনতাই করার কারণে পুলিশের ভাষায় এরা ‘সালাম পার্টি’। ‘সালাম পার্টি’র সদস্যরা উন্নত মানের শার্ট, প্যান্ট, জুতা, এমনকি শীতকালে কোট-টাই পরে ঘুরে বেড়ায়। তাদের দেখলে মনে হবে কোনো করপোরেট অফিসে বড় পদে চাকরি করে, অথবা কোনো বড় ব্যবসায়ী। বাচনভঙ্গি ও চালচলনে রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। হঠাৎ সামনে হাজির হয়ে সালাম দেবে। বিশেষ কায়দায় তারা চাকু, চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র নিজেদের প্যান্ট বা কোটের পকেটে লুকিয়ে রাখে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভদ্রলোকের বেশ ধরে তারা দু-তিন ঘণ্টার জন্য রিকশা ভাড়া করে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে। বিশেষ করে ব্যাংক অথবা এটিএম বুথের পাশে অবস্থান নিয়ে থাকে। লক্ষ্য রাখে কে টাকা নিয়ে বের হচ্ছে।

 গত ৫ ডিসেম্বর পল্টন থানা পুলিশ ‘সালাম পার্টি’ চক্রের পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে। পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা সালাম দিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। এমন ভাব দেখায় যেন পূর্বপরিচিত। পরে কয়েকজন মিলে ঘিরে ধরে টাকা, মুঠোফোন ও মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত কেটে পড়েন।

সর্বশেষ খবর