শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর টিনএজ গ্যাং

মির্জা মেহেদী তমাল

ভয়ঙ্কর টিনএজ গ্যাং

উত্তরা থানা পুলিশের একটি দল একজন ব্যবসায়ীর বাসায় অভিযান চালায়। তারা ব্যবসায়ীর ছেলেকে ধরে নিয়ে আসতেই তাদের এই অভিযান। কিন্তু ছেলেটির বাবা পুলিশকে বলে, অফিসার, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার ছেলে স্কুলে পড়ে। ওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তবে কেন আমার ছেলেকে ধরতে এসেছেন? পুলিশের জবাব, স্যার, আমাদের কোনো ভুল হচ্ছে না। আমরা আপনার ছেলেকেই ধরতে এসেছি। আপনার স্কুলপড়ুয়া ছেলে খুনের মামলার আসামি। আমরা যতদূর তদন্তে জেনেছি, খুনের সঙ্গে আপনার ছেলে সরাসরি জড়িত। পুলিশের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়েন ব্যবসায়ী। ভিতরের ঘর থেকে পুলিশের সামনে ছুটে আসেন ব্যবসায়ীর স্ত্রী। তিনি কান্না করতে থাকেন। পুলিশের উদ্দেশে বলেন, আমার বাচ্চা ছেলে সম্পর্কে এমন কথা কেন বলছেন। আমার ছেলে সকালে বাসা থেকে বের হয়ে স্কুল-কোচিং ইত্যাদি নিয়ে থাকে। তারপর বিকালে বাসায় এসে কিছুক্ষণ খেলাধুলা করতে বের হয় এবং সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আসে। এই সময়ের মধ্যে বাজে কাজ তাও খুনখারাবির মতো কোনো কাজ করতে পারে না। পুলিশ বলে, আপনাদের ছেলে একটি গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত। একপর্যায়ে পুলিশ ওই বাসা থেকে উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান খুনের আসামি ওই ছেলেকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় পশ্চিমা সংস্কৃতির ধাঁচে গড়ে উঠেছে কিশোর বয়সী ছেলেদের টিনেজ গ্রুপ। কিন্তু অভিভাবকরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তাদের সন্তানরা স্কুলে পড়াশোনা আর মাঠে খেলাধুলার বাইরে অন্য কিছু নিয়েও মেতে ছিল, তা মানতেও পারছেন না তারা। কিন্তু পুলিশ সম্প্রতি উত্তরায় কিশোর আদনান হত্যার দায়ে অপরাধীদের ধরতে বাসা-বাড়িতে গেলে অভিভাবকরা বিস্মিত হন। তখন শুনলেন তাদের সন্তানদের স্কুলের পড়াশোনা এবং খেলার মাঠের খেলাধুলার বাইরেও একটি জগৎ আছে। যেখানে তারা গ্যাং গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেছে। হয়ে উঠছে দুর্ধর্ষ এবং এরই মধ্যে তাদের দ্বন্দ্বে মারামারি, কাটাকাটি এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত ঘটে গেছে। পুলিশ তৎপর হওয়ার পরও থামানো যাচ্ছে না টিনেজ গ্রুপের খুনখারাবি। জানা গেছে, সাধারণত ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সের কিশোররা এসব গ্রুপ গড়ে তোলে উত্তরায়। এর ঢেউ লাগে শহরের সর্বত্র। সাধারণ শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিং, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত এসব গ্রুপের সদস্যরা। আধিপত্য বজায় রাখতে প্রায়ই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে তারা। আদনান হত্যাকান্ডের পর তার বাবার দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার করা হয় সাদাফ জাকির ও নাসির আলম ডন নামে দুজন গ্যাং সদস্যকে। মেহেরাব হোসেন নামে আরেক গ্যাং সদস্যকেও আটক করা হয়। মামলায় শুরুতে ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবে ছিল মেহেরাব।

পুলিশ জানায়, রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, মিরপুর ও যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় কিশোরদের পৃথক গ্যাং রয়েছে। তারা নিজেরাই নানা ধরনের নাম দিয়েছে এসব গ্যাংয়ের। গত ৯ আগস্ট র‌্যাব-২ কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, কলেজগেট, শিশু মেলা, শ্যামলী এবং মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ৪৮ সদস্যকে গ্রেফতার করে। পরে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের প্রত্যেককে ছয় মাসের জন্য কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তাদের গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্ব : শিপন, মুন্না, সজীব, মিনহাজ, আদনান। বয়স ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। প্রত্যেকেই বন্ধু। এরা রাজধানীর কদমতলী রায়েরবাগ এলাকার বাসিন্দা। একই বয়সের আরও অন্তত ১৫-১৬ জন রয়েছে যারা একসঙ্গেই চলাফেরা করে। একসময় সজীব, মিনহাজ, আদনান নিজেদের সিনিয়র দাবি করে। কিন্তু শিপন আর মুন্নাসহ অন্যরা তা মানতে রাজি নয়। একসঙ্গে চলাফেরা করলেও একসময় তারা দুই গ্রুপে চলাফেরা করতে শুরু করে। সজীবরা একসময় নিজেদের এলাকা বাদ দিয়ে অন্য এলাকায় গিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করে। দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ নিয়ে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে দুই গ্রুপে ঝগড়া, হুমকি চলতে থাকে। তারা নিজেরা একসময় চিন্তা করল দ্বন্দ্ব তারা রাখবে না। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে শেষ করবে। আলোচনার জন্য শিপন, মুন্নারা স্থানীয় মুজাহিদ খানকা শরিফের ভিতরে অপেক্ষায় ছিল। হঠাৎ সজীব, মিনহাজ, আদনানসহ ১৫-২০ জন সেখানে হামলা চালায়। শিপনদের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। তারা শিপনের বুকে, মুন্নার বাম হাত ও চোখে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। আহত অবস্থায় তাদের দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শিপনকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ জানায়, টিনেজ গ্রুপের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে দ্বন্দ্বে এই খুনের ঘটনা ঘটে। দক্ষিণখানে রয়েছে দুটি টিনেজ গ্রুপ। একটি শান্ত ও অপরটি আরাফাত গ্রুপ। আরাফাত গ্রুপের এক সদস্য কাউসার শান্ত গ্রুপের মেহেদীকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে। এই তুই বলার জেরে দুই গ্রুপ অশান্ত হয়ে পড়ে। শান্ত গ্রুপের ছেলেরা আরাফাত গ্রুপের কাউকে দেখলেই হামলা চালায়। ঘটনাটি কয়েক সপ্তাহ আগের। জানা গেছে, শান্ত গ্রুপের সদস্যরা আরাফাত গ্রুপের সাইফকে মারধর করে। এর পরপরই পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি প্রোগ্রামে মিছিল নিয়ে আসার পর মেহেদীর ওপর হামলা চালায় আরাফাত গ্রুপের সদস্যরা। আরাফাত গ্রুপের সানি ও সোহেল মেহেদীকে জড়িয়ে ধরে এবং সাইফ চাকু দিয়ে মেহেদীর বাম কানের নিচে আঘাত করে এবং অন্যরা লাঠি দিয়ে পেটায়। আহত অবস্থায় মেহেদীকে প্রথমে দক্ষিণখানের কেসি হাসপাতাল ও পরবর্তীতে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। পুলিশ জানতে পারে, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জের ধরে এই দুই গ্রুপে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা এবং সমাজে আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে এই ধরনের ক্যাডার বাহিনী তৈরি হয়। এ জন্য সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন এবং সংস্কৃতির মোকাবিলার ওপর জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, এই টিনএজাররা পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণ এবং ইন্টারনেটের মতো দ্রুততম যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন। কিন্তু আমরা আমাদের শিশুদের খারাপ প্রভাব মোকাবিলা করতে শিখাতে পারছি না। তিনি এ বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর