রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

রাজধানীতে এক টুকরো গঙ্গাসাগর দিঘি

মোস্তফা মতিহার

রাজধানীতে এক টুকরো গঙ্গাসাগর দিঘি

সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের স্মৃতিবিজড়িত গঙ্গাসাগর দিঘি -জয়ীতা রায়

সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের স্মৃতিবিজড়িত রাজধানীর সবুজবাগ থানার রাজারবাগের কালীবাড়ির ঐতিহাসিক গঙ্গাসাগর দিঘি। পাশেই বরদেশ্বরী কালী মন্দির। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত দৃষ্টিনন্দন মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এটি এখন রাজধানীর সৌন্দর্যপিপাসু বাসিন্দাদের অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র হিসেবেও ঠাঁই করে নিয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে প্রকৃতির অবারিত সুষমা গঙ্গাসাগর দিঘিতে টেনে আনে ভ্রমণপ্রিয়দের। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগে হৃদয় আর চোখকে শীতল করার পাশাপাশি সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের স্মৃতিতেও ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে পারেন দর্শনার্থীরা। অতীত আর বর্তমানের সঙ্গে ইতিহাস ও নান্দনিকতার সেতুবন্ধনে সৌন্দর্যপিপাসুদের মানসপটে চিত্রিত হবে ভিন্ন এক ভালো লাগা।

১১.৪৪ একর জমি নিয়ে গঙ্গাসাগর দিঘি। আশপাশের দক্ষিণগাঁও, নন্দীপাড়া, বাসাবো, মা া, মাদারটেক, গোড়ান এলাকায় যখন পানি থাকে না, তখন এসব এলাকার বাসিন্দারা গঙ্গা সাগরের পানি নিয়ে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরকন্নার সব কাজ করেন। মন্দিরের প্রবেশ পথের ডান দিকে অফিস কক্ষ, বাম দিকে শিব মন্দির। যার মধ্যে স্থাপন করা আছে শিবলিঙ্গ। এর সামনেই প্রধান মন্দিরের পশ্চিমে গঙ্গাসাগর দিঘি। পাশেই হিজলতলা গাছের শীতল ছায়ায় দিঘির পূর্ব ও উত্তর কোনায় রয়েছে মহাদেবের তীর্থস্থান। জনসাধারণের সুবিধার জন্য দিঘির পূর্ব এবং দক্ষিণে রয়েছে শানবাঁধানো ৩টি পাকা ঘাট। পশ্চিম পাশে রয়েছে শিতলা মন্দির ও লোকনাথ বাবার আশ্রম। এক কথায় প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্যের হাতছানিতে এখানে আগতরা মুগ্ধ হবেই।

বাংলা বিজয়ের উদ্দেশে মোগল সম্রাট আকবর তার প্রধান সেনাপতি রাজা মানসিংহকে যখন এ বাংলায় পাঠান তখন রাজা মানসিংহ ডেমরার অদূরে তৎকালীন রাজধানী সেনের ভাগের ঈশা খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে এখানে তাঁবু ফেলেন। এ এলাকায় তখন পানীয় জলের অভাব ছিল প্রকট। যার কারণে মানসিংহ তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে খনন করেন গঙ্গাসাগর দিঘি। দিঘির উত্তর-পশ্চিম কোণায় একটি মহাশ্মশানও প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত পাশ্চাত্যের বিশিষ্ট পি ত এফবি ব্রাংকলে বার্ট তার ‘দি রোমান্স অব এন ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’ বইয়েও সুস্পষ্টভাবে এই বিষয়টির উল্লেখ করেছেন। ‘প্রাচ্যের রহস্য নগরী’ নামে পরবর্তীতে বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন রহিম উদ্দিন আফজে। আর সেটিতেও এই বিষয়ের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। 

বঙ্গাব্দ ১৩০৪ সালে হলধর দে সরকার নামে স্থানীয় এক ধর্নাঢ্য ব্যক্তি ধর্মীয় উদ্দেশে এই তীর্থ ভূমিটিকে কালীমাতার নামে এবং রেজি: মিরাশী পাট্টা বা অর্পণনামা দলিলের মাধ্যমে চিরস্থায়ী দেবোত্তর করে দান করে যান। পরবর্তীতে কৃপাময়ী দেবীসহ আরও কয়েকজন ভক্ত ধর্মীয় উদ্দেশে কালীমাতার নামে ভূমিদান করেন। তখন থেকে এই দেবোত্তর সম্পত্তির আয়ের অর্থ দ্বারা এবং স্থানীয় ভক্তদের সহযোগিতায় মন্দিরের পূজা অর্চনাসহ যাবতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়ে আসছে। অর্পণনামা দলিল দ্বারা নিয়োগকৃত সেবায়েত অনাথ বন্ধু চক্রবর্তী বাংলা ১৩০৬ সালে মন্দিরটি পুনঃসংস্কার করেন ও দাতার নির্দেশে এটির নামকরণ করেন শ্রীশ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির। চিরকুমার অবস্থায় অনাথ বন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে মন্দিরের কর্মকা  পরিচালনা করে আসছেন স্থানীয় জনসাধারণ ও ভক্তরা। বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও গঙ্গাসাগর দিঘি ঘিরে বিভিন্ন উপলক্ষে নানা ধরনের উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে, পূর্ণিমা তিথিতে অষ্টমী ¯œান, বারণী ¯œান ও পয়লা বৈশাখ উদযাপনে এখানে বসে তিন দিনের মেলা। জাঁকজমকপূর্ণ এই মেলার সাংস্কৃতিক পর্বে থাকে নাটকের মঞ্চায়ন, যাত্রাপালা ও সংগীতের আসর। সরেজমিন মন্দির পরিদর্শনে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর এই প্রতিষ্ঠানটির সম্পত্তি দিন দিন মূল্যবান হওয়ায় একটি চিহ্নিত অপশক্তি এটি আত্মসাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং একটি মন্দিরের বহু মূল্যবান সম্পদ নষ্ট করতে থাকে। এতে মন্দিরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করে। চক্রটি মিথ্যা মামলা, জাল দলিল, নকল কাগজপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি গ্রাস করার পাঁয়তারা চালিয়ে আসছে বলেও জানা গেছে। সম্পত্তি রক্ষার্থে এবং মন্দির পরিচালনার জন্য ১৯৯৫ সালের মে মাসে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট শ্রীশ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা ও শ্মশান কমিটি পুনর্গঠিত হয়। এ কমিটির বর্তমান সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর লায়ন চিত্ত রঞ্জন দাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মন্দিরের পবিত্রতা ও সম্পত্তি রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলাম বলে আমাদের কমিটির কয়েকজনকে কয়েকটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তাই আমি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। মন্দিরের উন্নয়নে এখানকার শ্মশানে যে কোনো সংখ্যালঘুর মৃতদেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে মৃত জনপ্রতি ১ হাজার টাকা করে নেওয়া হয় বলেও জানান চিত্ত রঞ্জন দাস। উৎপল কুমার দাস নামে কমিটির আরেক সদস্য জানান, আগে ঐতিহাসিক দিঘি থেকে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা মাটি কেটে নিত। এটা বন্ধ করার জন্য বাউন্ডারি হিসেবে ১৬১টি দোকান এবং পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে মোট ৭০টি আবাসন গৃহনির্মাণ করা হয়। যাতে বাইরের কেউ দিঘির পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে। মন্দিরের পূজক গোপাল চক্রবর্তী জানান, দিঘির বাউন্ডারি হিসেবে এসব গৃহ ও দোকানপাট নির্মাণ করায় মন্দিরের পরিবেশ সুন্দর হয়েছে।

প্রতি বছর এখানে দেশ বিদেশের বুদ্ধমনিষী, ধর্মযাজক, সাধুসহ বহু পর্যটক মন্দির পরিদর্শনে আসেন এবং গঙ্গাসাগর দিঘিতে ¯œান করেন।

সর্বশেষ খবর