শনিবার, ৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

ইতিহাসের নান্দনিক ঐতিহ্য নওগাঁর ভাঙা মসজিদ

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

ইতিহাসের নান্দনিক ঐতিহ্য নওগাঁর ভাঙা মসজিদ

প্রাচীন ঐতিহ্যের ছাপ দেদীপ্যমান মসজিদটির পরতে পরতে। নান্দনিক নকশা ও সুনিপুণ নির্মাণ কাজ জানান দেয় মুসলিম ইতিহাসের নান্দনিকতার কথা। শৈল্পিক অবকাঠামো সমৃদ্ধ এত সুন্দর একটি মসজিদ এখানে রয়েছে তা অনেকে জানেনও না। বলছি, ধর্মপুর ভাঙা মসজিদের কথা। এটি জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামে অবস্থিত। স্থাপত্যকলা, শিল্প-সৌন্দর্যের আধার ধর্মপুর ভাঙা মসজিদটি ঠিক কত বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল এর সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, কোনো এক সময় প্রাচীন মসজিদটির আশপাশে মুসলিম জনবসতি ছিল এবং মসজিদের পাশে বিশাল পুকুর থাকার কারণে এখানে প্রাচীন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। আবার কী কারণে তারা মসজিদটির আশপাশ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য আজও কেউ বলতে পারেননি। এর গঠন পদ্ধতি ও স্থাপত্য কৌশল শিল্পসমৃদ্ধ ও অনন্য। ৯ গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদটির ভিতর রয়েছে চারটি সুদৃঢ় খিলান। দরজা রয়েছে মাত্র একটি। দ্বিতল ভবনের ভিতরে মেহরাব ও দেয়ালে অঙ্কিত রয়েছে বিভিন্ন কারুকাজের ফুলদানি ও ফুল। মসজিদের দেয়ালের গাঁথুনি চার ফুট প্রস্থ, যা চুন ও সুরকি দিয়ে গাঁথা। প্রাচীন স্থাপত্যকলার সুদৃশ্য মসজিদটি চিকন ইট, চুন সুরকির নির্মিত দেয়ালে এখনো নকশা করা কারুকাজ রয়েছে। চারটি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে নয় গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদের নির্মাণশৈলী মনোমুগ্ধকর। এর আয়তনের সঠিক তথ্য জানা যায়নি। মসজিদটির সিঁড়িসহ প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূল ভবন বা নামাজ ঘর তিনটি অংশে বিভক্ত। বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে মসজিদটির সম্ভাব্য বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ বছর।

মসজিদটির পার্শ্ববর্তী ধর্মপুর পাইকপাড়া মন্ডলপাড়া জামে মসজিদের মুসল্লি আনিছুর রহমান (৮০) বলেন, আমার নিজের চোখে দেখা মসজিদটি ২০ বছর আগেও অনেক সুন্দর ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন প্রাচীন এই মসজিদটি দেখতে। এখানে শুধু দুই ঈদের নামাজ হতো। শেষ ঈদের জামাত ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত হয়। বাপ-দাদার মুখ থেকে শুনেছি ১৯২০ সালে মহাভূমিকম্পে ৯টি গম্বুজসহ মসজিদটির কিছু অংশ ভেঙে যায়। তারপর থেকেই এটি ভাঙা মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, মসজিদটির একটি দরজার ওপর মূল্যবান কষ্টি পাথরে খোদাই করে আরবি ভাষায় কোরআনের সুরা লেখা ছিল। মহামূল্যবান ওই পাথর ৩০-৩৫ বছর আগে কে বা কারা চুরি করে নিয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা তায়েজ উদ্দিন বলেন, এই প্রাচীন মসজিদটি আমার ধারণা মতে ৩০০ বছরের পুরাতন হবে। আমার বাপ-দাদারাও সঠিক কবে নির্মাণ হয়েছিল তা বলে যেতে পারেননি। গত বছর সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কিছু লোক এসে গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছিল। তারপর আজ পর্যন্ত তাদের আর কোনো খোঁজ-খবর নেই। এই মসজিদে আমি নামাজ পড়েছি। মসজিদটি পুনরায় সংস্কার করলে গ্রামবাসীর ভালোই হয়। পাশাপাশি দেশের ঐতিহ্যও রক্ষা পায়। স্থানীয় কয়েকজন যুবকের উদ্যোগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর  বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ পদ্ধতিতে ২০২০ সালের মসজিদটির দেয়ালে গাছ,  শৈবাল, ছত্রাক ও জঙ্গলে ঢাকা ভবনটির বিভিন্ন অংশের যথাযথ নথিভুক্তির জন্য আংশিকভাবে ড্রাই ক্লিনিং করা হয়। তিনি আরও বলেন, তবে এ উপজেলার একমাত্র পুরাকীর্তি ঐতিহাসিক প্রাচীন মসজিদটির প্রতি সরকারি বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ধর্মভীরু মুসলিম বিত্তশালীরা কেউই এটির প্রতি দৃষ্টিপাত করছেন না। ফলে মসজিদটির যে অংশটুকু এখনো অবশিষ্ট রয়েছে, তাও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশবাসীর কাছে আকুল আবেদন প্রাচীন স্থাপত্যকলার সুদৃশ্য ধর্মপুর মসজিদ রক্ষায় সবাই এগিয়ে আসুন।

নিয়ামতপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান ইতিহাস বিভাগ ফারুক হোসেন বলেন, নওগাঁর ইতিহাস ঐতিহ্যর অংশ হিসেবে এই মসজিদটি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সরকার এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারিয়া জয়া পেরেরা বলেন, মসজিদটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে গ্রামবাসীর স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠিয়েছি। শিগগির এই মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় থাকবে বলে তিনি জানিয়েছেন। বগুড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, আনুমানিক ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের ৯ গম্বুজবিশিষ্ট ৪টি পিলার ও পশ্চিম দিকে মেহেরাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা দেখে মনে হয় এটি মুঘল আমলের একটি মসজিদের ভিত্তি। ৯ গম্বুজ মসজিদটি বর্তমানে জেলায় দ্বিতীয় স্থানে থাকবে। আমরা মসজিদ এলাকা ঘুরে দেখেছি। প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এটি সংরক্ষণযোগ্য। স্থানীয় লোকজন এবং মুসল্লিরাও এটি সংরক্ষণের পক্ষে মত দিয়েছেন। মসজিদটিকে প্রত্নতাত্তি¡ক নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে এর সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনা করার ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। নওগাঁর জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ বলেন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছে। মসজিদটি নওগাঁর এবং আমাদের দেশের একটি ঐতিহ্য। এটিকে রক্ষা করা আমাদের সবার কর্তব্য।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর