পূর্বাচল থেকে ঢাকার পথে ৩০০ ফিট রাস্তার পাশে পড়ে আছে অজ্ঞাত এক তরুণীর লাশ। সকাল বেলা পথচারীদের চোখে পড়ে লাশটি। ৯৯৯-এ কল করার কিছু পরই খিলক্ষেত থানার পুলিশ আসে ঘটনাস্থলে। আসে গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব। সাত সকালে লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি চাউর হয়ে যাওয়ার পর মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। আতঙ্কের ছাপ মানুষের মুখে। কে বা কারা নারীকে হত্যার পর ফেলে রেখে যায় ৩০০ ফুট সড়কের পাশের একটি ঝোপে। ঘটনাস্থলে ফরেনসিকভ্যান নিয়ে ছুটে আসে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ও তদন্ত টিম। বেওয়ারিশ লাশের পরিচয় সন্ধানে ফরেনসিক ডিভাইসের মাধ্যমে ফিংগার প্রিন্ট মেলানোর চেষ্টা করেন সিআইডির কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে সিআইডিকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। যতটুকু কঠিন হবে বলে মনে করছিলেন সিআইডির কর্মকর্তারা, ততটুকু হয়নি। মুহূর্তেই লাশের নাম-পরিচয় বেরিয়ে আসে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী নারীর নাম সুমি হাসান। পিতা চান মিয়া শেখ। ঠিকানা কোটালিপাড়া, গোপালগঞ্জ। তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এগিয়ে যান সিআইডি কর্মকর্তারা। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। সেদিন ছিল ২০২০ সালের ১৯ জুন। ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে সিআইডি সুমির এমন একটি জীবনের সন্ধান পেয়েছেন যার শুরু এবং শেষ দুটোই হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে। এর মধ্যকার ২৭ বছরের সময়টুকুতে আছে বিয়ে, বিচ্ছেদ আর উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কিছু চিহ্ন।
সিআইডির তদন্ত এখন গোপালগঞ্জে। কোটালিপাড়ায় খবর নিতে বলা হয় সুমি হাসানের বাবা চান মিয়া শেখের। কিন্তু পুলিশ খবর নিয়ে জানতে পারে, সুমি হাসান বা চান মিয়া শেখ নামের কেউ সেখানে থাকেন না। খটকায় পড়ে যায় সিআইডি। কোথায় ঠিকানা পাবে এ নিয়ে চিন্তিত সিআইডি কর্মকর্তারা। তখন অন্য উপায়ে তদন্ত শুরু করেন তারা। লাশ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলেই একটি নোকিয়া ফোন সেট উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই ফোনের সিম নম্বরের মালিকের খোঁজ করে সিআইডি জানতে পারে, এই সিমটি জাহিদ নামে এক ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত। ঠিকানা দেওয়া আছে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া। সিআইডি এবার জাহিদের খোঁজ করতে থাকেন। কোটালিপাড়ায় জাহিদের বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু জাহিদ সেখানে নেই। জাহিদের নম্বর জোগাড় করে সিআইডি। সিআইডি এবার তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহিদের অবস্থান জানার চেষ্টা করে। জাহিদের লোকেশন তারা পায় রাজধানীর জিগাতলায়। সিআইডি সময় নষ্ট না করে ছুটে যায় জিগাতলায়। বিভিন্ন বাসায় খোঁজ করতে করতে জাহিদের অবস্থান নিশ্চিত হয় সিআইডি। তারা জানতে পারেন, জাহিদ পেশায় একজন ড্রাইভার। একটি মহিলা হোস্টেলের নিচে তিনি থাকেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা রাতে ফোন দেন জাহিদকে। গাড়ি ভাড়ার কথা বলে তাকে সামনে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু জাহিদ এড়িয়ে যান। সিআইডি নিশ্চিত হয়, শিকার তাদের হাতের মুঠোয়। পরদিন আবারও জাহিদের খোঁজে যায় সিআইডি। এবার পেয়ে যায়। তাকে সোজা সিআইডি কার্যালয়ে নিয়ে জেরা শুরু করে। সুমির কথা জিজ্ঞাসা করলে জাহিদ তাকে চেনে বলে স্বীকার করে। সুমি তার স্ত্রী ছিল। ২০১০ সালে তিনি প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বনিবনা হচ্ছিল না। ২০১৪ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। তবে এরই মধ্যে এক মেয়ে (৯ বছর) ও এক ছেলের (৭ বছর) জন্ম হয়। সন্তানদের নিয়ে সুমি তার মায়ের কাছে চলে যায়। প্রতি মাসে দুই সন্তানের জন্য ২ হাজার টাকা করে খরচ পাঠাতেন। সর্বশেষ ২০২০ সালের রোজার মাসে এরপর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। হতাশ সিআইডি কর্মকর্তারা। তারা জাহিদের কাছে সুমির মায়ের ঠিকানা চান। জাহিদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে রাজধানীর বাড্ডায় সুমির মায়ের কাছে হাজির হয় সিআইডি। জানতে চায় সুমির খবর। সুমির মা তখন জানায়, সুমি তার পালক মেয়ে। ২৭ বছর আগে সুমিকে কোনো এক নারী অপরিচিত একটি ছোট ছেলের কোলে রেখে চলে যান। ছেলেটিকে তিনি বলেছিলেন মজার খাবার নিয়ে আসছেন। কিন্তু আর ফেরেননি। তখন সুমির ২ মাস বয়স। তিনি বলেন, তার নিজের কোনো সন্তান নেই। এলাকার লোকজন তখন তাকে শিশুটির লালন-পালনের দায়িত্ব দেন। শিশুটির কোনো নাম-পরিচয় তাদের জানা নেই। অসুস্থ হওয়ায় তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে তার নাম দেওয়া হয় সুমি। তারা তাকে সুমি বলেই ডাকতেন। তিনি বলেন, নিজের মেয়ের মতোই তিনি সুমিকে লালন-পালন করেছেন। সুমি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সময় এলাকার ছেলেরা বিরক্ত করতে শুরু করেন। পড়ালেখা তখন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জাহিদ নামে এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়। কিন্তু তার সঙ্গে সংসার হয়নি। সুমির লাশের পরিচয় নিয়ে ধন্দে পড়ে যান সিআইডি কর্মকর্তারা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ধরে খোঁজ নিয়ে পরিচয় মেলেনি। সাবেক স্বামী রাজধানীর ঝিগাতলায় নারীদের একটি হোস্টেলে দারোয়ানের কাজ করেন বলে জানতে পারেন। তাকে বের করলে তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে যান সুমির পালক বাবা-মা ও সন্তানদের কাছে।
সুমি কোথায় থাকেন, কী করেন সে বিষয়ে তার পালক বাবা-মা কিছুই জানতেন না। বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী সুমির জীবনের কারও সঙ্গে তাদের যোগাযোগও ছিল না। তাই তারা কিছু বলতেও পারছিলেন না। তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া সুমির ৯ বছরের মেয়েটি তার একটি খাতা নিয়ে আসে। সেখানে ‘ইমার্জেন্সি’ নামে একটি মুঠোফোন নম্বর টুকে রাখা ছিল।মুঠোফোন নম্বরটি ধরে এর মালিককে খুঁজে বের করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ওই ব্যক্তি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। তার নিজের পরিবারেও টানাপড়েন চলছে। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে তিনি এবং সুমি একসঙ্গে থাকতেন। তাদের পাশেই থাকেন আরেক নারী। এই নারীই সুমিকে হোটেলে নাচের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। সিআইডি কথা বলে ওই নারীর সঙ্গে। ওই নারী জানান, সুমি সর্বশেষ ফারুকুল ইসলাম নামে কমলাপুর রেলস্টেশনের এক জেনারেটর অপারেটরের কাছে গিয়েছিলেন। তিনিই ফারুকের বাসাটি চিনিয়ে দেন।
নন্দীপাড়ায় ফারুকের বাবার দোতলা বাসা। নিচতলায় ফারুকের বাবা-মা থাকেন। আর দোতলায় তার বন্ধু সালাউদ্দিন খলিফা ওরফে সুমন ও তার বন্ধু কাজী ইমরান মাহমুদ থাকেন। সালাউদ্দিন একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকের চাকরি করেন। আর ইমরান মুঠোফোনভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেল চালান। সিআইডি এই তিনজনকে তিন স্থান থেকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে ফারুক আবার সিআইডির গতিবিধি নজরে রাখছিলেন। তাদের নাম চলে আসে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতেন। এই তিনজনই সুমিকে তিন দিন আটকে রেখে জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন করেন। ১৮ জুন তার মৃত্যু হলে পরদিন একটি সিএনজিতে করে তারা লাশ নিয়ে ৩০০ ফিট সড়কে ফেলে আসেন। এই তিনজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। করোনাভাইরাসের কারণে হোটেলগুলোতে নাচ-গান বন্ধ হয়ে যায়। সুমিও তাই কয়েক মাস ধরে বেকার ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে নিজের এবং সন্তানদের খরচ জোগান দিতেই তিনি এই পথ বেছে নিয়েছিলেন বলে তারা মনে করছেন। সুমির পিত্তথলিতে পাথর হয়েছিল। এজন্য তিনি প্রায়ই শারীরিক বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতেন। গ্রেফতার তিনজনকে তিনি শরীর খারাপের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাকে নিস্তার দেয়নি। পুলিশের জেরায় ফারুক বলেন, সুমি হাসান শারীরিক সম্পর্কের জন্য ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু তিনজনই ৩০ হাজার টাকা নাই বলে অস্বীকৃতি জানান। টাকা না দিলে ভিকটিম সুমি আসামি ফারুকের স্ত্রীকে সব বলে দেবেন বলে হুমকি দেন। এরপরই সুমিকে খুনের পরিকল্পনা করেন তারা। তারা পরস্পর যোগসাজশে সুমি হাসানকে গত ১৮ জুন রাতে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। হত্যার পর লাশ গুম করতে পরদিন সকালে অপরিচিত সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে পূর্বাচল থেকে ঢাকাগামী ৩০০ ফিট রাস্তার পাশের ঝোপে ফেলে যান। সিআইডির অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) শেখ ওমর ফারুক বলেন, গত ১৫ জুন মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। চার্জশিটে তিনজনকে আসামি করা হয়।