সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

জ্বালানি তেল খালাসে নতুন যুগে বাংলাদেশ

বছরে সাশ্রয় ৮০০ কোটি টাকা - প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ - আগামী বছর আগস্টে চালু

জিন্নাতুন নূর, মহেশখালী থেকে ফিরে

জ্বালানি তেল খালাসে নতুন যুগে বাংলাদেশ

আমদানি করা পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিবহন এবং সঞ্চালনে নতুন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমদানি করা ক্রুড অয়েল ও ফিনিশড প্রডাক্ট দ্রুত ও স্বল্প খরচে নিরাপদে খালাস করতে সাগরের বুকে বাস্তবায়িত হচ্ছে বিশাল এক প্রকল্প। এ জন্য সরকার মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের দাবি, ডাবল পাইপলাইনে তেল খালাস শুরু হলে সরকারের বার্ষিক সাশ্রয় হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। আর এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গভীর সমুদ্রে নোঙর করা বড় জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল খালাসে আর লাইটার জাহাজের প্রয়োজন হবে না। পাইপলাইনের মাধ্যমে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় খালাস হবে ১ লাখ ২০ হাজার টন তেল, যা আগে খালাসে সময় লাগত ১২ দিন। এর ফলে সারা দেশে জ্বালানি তেল সরবরাহেও গতি বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে জ্বালানি তেলের মজুদক্ষমতা।

সরেজমিন ঘুরে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসপিএম প্রকল্পটি মহেশখালী দ্বীপের পশ্চিম পাশে সাগরে স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে জাহাজ থেকে তেল সরাসরি পাম্প করা হবে, যা এসপিএম হয়ে অফশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মাতারবাড়ীর যেখানে ল্যান্ড টার্মিনাল শেষ হয়েছে সেখানে পৌঁছাবে। পরে সেখান থেকে অনশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালী এলাকায় নির্মিতব্য স্টোরেজ ট্যাংকে জমা হবে। এসপিএম থেকে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের দুটি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোড করা হবে। ট্যাংক থেকে পাম্পিংয়ের মাধ্যমে তেল প্রথমে অনশোর ও পরে অফশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের গহিরা ল্যান্ড টার্মিনালের শেষ পর্যন্ত আসবে। সেখান থেকে পুনরায় অনশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে কর্ণফুলী ইপিজেডের ভিতর দিয়ে ডাঙার চর পর্যন্ত এসে কর্ণফুলী নদী এইচডিডি পদ্ধতিতে অতিক্রম করে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ভিতর দিয়ে ইআরএলে (ইস্টার্ন রিফাইনারি লি.) পাঠানো হবে। ট্যাংক ফার্ম থেকে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের দুটি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে ডেলিভারি করা হবে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পে মোট অফশোর পাইপলাইন ১৩৫ কিলোমিটার। এ ছাড়া এইচডিডি ক্রসিংয়ের অফশোর অংশ ১১ কিমিসহ মোট ১৪৬ কিমি। এ ছাড়া অনশোর পাইপলাইন ৭৪ কিমি। ১৮ ইঞ্চি ও ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন প্রায় ২২০ কিমি। এসপিএম প্রকল্পের আওতায় মহেশখালী এলাকায় স্টোরেজ ট্যাংক ও পাম্পিং ট্যাংক স্থাপন হবে তিনটি ক্রুড অয়েল (প্রতিটির নেট ধারণক্ষমতা ৫০ হাজার ঘন মিটার) এবং তিনটি ডিজেল ট্যাংক (প্রতিটির নেট ধারণক্ষমতা ৩০ হাজার ঘনমিটার)। আরও থাকবে স্কাডা, প্রধান পাম্প, বুস্টার পাম্প, জেনারেটর, মিটারিং স্টেশন, পিগিং স্টেশন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। প্রকল্পের পাম্পিং স্টেশন ও ট্যাংক ফার্ম নির্মাণের জন্য মহেশখালীতে নির্বাচিত এলাকায় ভূমি উন্নয়নের কাজ প্রায় ৯৩ শতাংশ শেষ হয়েছে। স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের কাজ চলমান আছে। এরই মধ্যে ছয়টি ট্যাংকের মেকানিক্যাল কাজ অনেকাংশে শেষ হয়েছে। কুতুবদিয়া চ্যানেল ও মাতারবাড়ী অ্যাপ্রোচ অংশে ডিপ পোচ ট্রেসিং পদ্ধতিতে চারটি পাইপলাইন নির্ধারিত গভীরতায় স্থাপনের কাজও শেষ।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বার্ষিক জ্বালানি তেল আনলোডিং ক্ষমতা হবে ৯.০ মিলিয়ন টন। ১ লাখ ২০ হাজার ডিডব্লিউটি ক্রুড অয়েল ট্যাংকার ৪৮ ঘণ্টায় এবং ৭০ হাজার ডিডব্লিউটি ডিজেল ট্যাংকার মাত্র ২৮ ঘণ্টায় খালাস হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) মাদার ভ্যাসেল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল দ্রুত বহন করার জন্য এসপিএম প্রকল্প শুরু করেছে। এর ফলে বার্ষিক ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে এটি বাস্তবায়িত হলে দেশে আধুনিক তেল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, ‘করোনার কারণে প্রকল্পটির গতি কিছু কমেছে। ফলে প্রকল্প ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য প্রকল্পটি চালু করতে নতুন শিডিউল নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করছি আগামী বছর আগস্টের মধ্যে এটি চালু করা যাবে। বর্তমানে দেশে সোয়া দুই মাসের তেল সংরক্ষণের ক্ষমতা আছে। এসপিএম প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রায় আড়াই মাসের তেল সংরক্ষণ করা যাবে। প্রকল্প পরিচালক মো. শরিফ হাসনাত বলেন, এটি বাস্তবায়িত হলে দেশে এক লাখ টন ধারণক্ষমতার তেলবাহী জাহাজ গভীর সমুদ্রে খালাসে সময় লাগবে দুই থেকে তিন দিন। কমবে তেল চুরি ও সিস্টেম লস। তিনি জানান, এরই মধ্যে প্রকল্পটির ৭০ শতাংশের কাজ শেষ হয়েছে।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এবং কর্ণফুলী নদী চ্যানেলের নাব্যতা কম হওয়ায় তেলবাহী বড় জাহাজগুলো সরাসরি জেটিতে এসে খালাস করা সম্ভব না। এসব জাহাজ গভীর সমুদ্রে নোঙর করে ছোট লাইটারেজের মাধ্যমে তেল খালাস করে। এতে এক লাখ টন ধারণক্ষমতার তেলবাহী জাহাজ খালাসে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জি-টু-জি ভিত্তিতে এসপিএম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পক্ষে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লি. এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইএলএফ কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ারস, জার্মানি নিয়োজিত। চায়না এক্সিম ব্যাংক প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা দিচ্ছে। এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের নভেম্বরে। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৬ লাখ ৫৬ হাজার ৮২৬ দশমিক ৮৭ লাখ টাকা।

সর্বশেষ খবর