শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিধির জাঁতাকলে জাহাজ ভাঙা শিল্প

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বিধির জাঁতাকলে জাহাজ ভাঙা শিল্প

জাহাজ ভাঙা ও পুনর্নির্মাণ শিল্পের জন্য একটি বিধিমালা করতে যাচ্ছে সরকার, যে বিধির ধাপে ধাপে বোর্ডের অনুমোদন আর বিভিন্ন সংস্থার ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান রয়েছে। ‘জাহাজ পুনঃ প্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিমালা-২০২২’ -এর খসড়ায় বলা হয়েছে, বোর্ডের অনাপত্তি ছাড়া কোনো জাহাজ ভাঙা বা পুনর্নির্মাণের জন্য আমদানি করা যাবে না, ব্যাংক কর্তৃক এলসি খোলা বা অন্য কোনো উপায়ে জাহাজ মালিককে অর্থও পরিশোধ করা যাবে না।

এই খসড়া বিধিমালাটির ওপর সম্প্রতি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতামত চেয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। ২ অক্টোবরের মধ্যে লিখিত মতামত দিতে বলা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জাহাজ পুনর্নির্মাণ শিল্পের কার্যক্রম একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে ২০১১ সালে ‘দ্য শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইক্লিং রুলস’ নামে একটি নীতি জারি হয়েছিল। এরপর ওই নীতিটিকে আরও বিস্তৃত পরিসরে এনে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃ প্রক্রিয়াজাতকরণ আইন জারি করা হয়। সেই আইনটি বাস্তবায়নের জন্যই বিধিমালাটি প্রণীত হচ্ছে। এই বিধিমালা কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২০১১ সালে জারি করা জাহাজ ভাঙা শিল্পের নীতিটি বাতিল হয়ে যাবে। খসড়া বিধিমালা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ড স্থাপনে ভূমির ইজারা, মালিকানা দলিল, চুক্তির কাগজ, পরিবেশ ছাড়পত্র, ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ছাড়পত্রসহ শিল্প মন্ত্রণালয়ের চাহিদামতো বিভিন্ন কাগজপত্র জমা দিতে হবে। জাহাজ আমদানি বা সংগ্রহের ক্ষেত্রে বোর্ডের অনুমোদন নিতে হবে। এ জন্য আবার জমা দিতে হবে ইয়ার্ডের হালনাগাদ পরিবেশ ছাড়পত্র, জাহাজ ক্রয়ের সমঝোতা স্মারক, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, বিপজ্জনক বর্জ্যরে তালিকাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র। এরপর জাহাজ সৈকতে আনার জন্য দিতে হবে রামেজিং সার্টিফিকেট, বিস্ফোরক পরিদফতরের সনদ, জাহাজের ক্যাপ্টেন কর্তৃক ওয়াটার এক্সচেঞ্জ সনদ, পরিবেশ ও সেফটি সনদসহ নানা কাগজ। জাহাজ ভাঙার আগে আবারও নিতে হবে প্রয়োজনীয় অনুমোদন, দিতে হবে বিভিন্ন ছাড়পত্র।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপক দিপঙ্কর চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিপ ব্রেকিং শিল্পের শুরু থেকেই আমাদের বিভিন্ন বিধি-বিধানের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। জাহাজ ভাঙা ও পুনর্নির্মাণের জন্য এখনো বিভিন্ন জায়গা থেকে অনাপত্তি ও ছাড়পত্র নিতে হয়। পরিবেশ ছাড়পত্র, নেভির ছাড়পত্র, বিস্ফোরক অধিদফতরের ছাড়পত্র, জাহাজ কাটার সময় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, কেটে পুনর্নির্মাণের সময় অনুমোদন- বিভিন্ন দফতর থেকে এ ধরনের অনুমোদন আর ছাড়পত্র নিতে নিতে অনেক সময় লেগে যায়। এ কারণে আমাদের দাবি ছিল ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর। বিধিমালা সহজ করে যদি এসব ছাড়পত্র ও অনুমোদন একই স্থান থেকে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয় তবে এটি শিল্পের জন্য ইতিবাচক হবে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জাহাজ পুনঃ প্রক্রিয়া) মো. জাফর উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৮ সালে যে আইনটি করা হয়েছিল, সেই আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বিধিমালাটি করা হচ্ছে। আমরা আইনের বাইরে নতুন কিছুই যোগ করিনি বরং আইনটি বাস্তবায়নের সুবিধার্থে বিধিমালায় অনেক বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে।  স্টেকহোল্ডার দাবি অনুযায়ী বিধিমালায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর বিষয়টিও উল্লেখ রয়েছে বলে জানান তিনি।

জরিমানা ও শাস্তি : নতুন স্থাপিত ইয়ার্ডে অনুমোদিত শিপ রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটি প্ল্যান (এসআরএফপি) বাস্তবায়ন ব্যতীত জাহাজ পুনঃ প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হলে ইয়ার্ডের কার্যক্রম বন্ধ বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে বিধিমালায়। ইয়ার্ডের অনুমোদন বা রিসাইক্লিংয়ের জন্য জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে কোনো মিথ্যা তথ্য দিলে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। ইয়ার্ডে প্রশিক্ষণবিহীন শ্রমিক নিয়োগ দিলে জরিমানা করা হবে ৫০ হাজার টাকা। ১৮ বছরের কম বয়সী শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে জরিমানা ৭৫ হাজার টাকা এবং পিপিই ছাড়া জাহাজ পুনর্নির্মাণ কাজে শ্রমিক নিয়োজিত থাকলে ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষকে প্রতি শ্রমিকের জন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। ইয়ার্ডে বা জাহাজে অগ্নিকান্ড বা কোনো দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হলে কর্তৃপক্ষ শ্রমিককে এককালীন ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং এককালীন এক বছরের বেতন-ভাতার সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করবে। আহত শ্রমিকদের ২ লাখ টাকা ও এক বছরের বেতন-ভাতার অর্থ পরিশোধ করতে হবে। মন্ত্রণালয় বা বোর্ডের আদেশ পালনে ব্যর্থ হলে নির্ধারিত মেয়াদে ইয়ার্ডের কার্যক্রম বন্ধ এবং অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে খসড়া বিধিমালায়।

যে কোনো তথ্য চাইতে পারবে বোর্ড : বিধিমালায় প্রস্তাবিত বোর্ডের কাছে প্রতি বছর ৩১ মার্চের মধ্যে ইয়ার্ডের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এ ছাড়া বোর্ড চাইলে ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যে কোনো সময় যে কোনো বিষয়ের ওপর বিবরণী, রিটার্নসহ যে কোনো তথ্য তলব করতে পারবে।

সরকারি খাসজমি ব্যবহারের সুযোগ : জাহাজ পুনঃ প্রক্রিয়াকরণ জোন স্থাপনের জন্য বিধিমালায় বেসরকারি মালিকানাধীন জমির বাইরে খাস বা সরকারি জমি ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে। অধিগ্রহণকৃত জমিতে জোন তৈরি করে, ওই জোনে তৈরি প্লট শিপ ব্রেকিং শিল্পের উদ্যোক্তাদের কাছে ইজারা দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের হাতে। ভৌগোলিক পরিবেশ, সমুদ্র তটের অবস্থা, যাতায়াত ব্যবস্থা ও জমির মালিকানার ওপর ভিত্তি করে প্লটের আকার ছোট-বড় হতে পারে।

বিধিমালা জারির আগে সংশ্লিষ্ট প্লটে আগে থেকেই কোনো ইয়ার্ড পরিচালনাকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই প্লট ইজারার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। এ ছাড়া প্লটে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থাকলে সেই জমির মালিক অথবা জমির মালিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্লট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। কোনো প্লটের জমির মালিকানা সম্পূর্ণ সরকারের হলে সেই প্লট ইজারার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। প্লটের ইজারার মেয়াদ ১০ বছর হবে এবং ইয়ার্ড পরিচালিত হলে পাঁচ বছর করে মেয়াদ বাড়ানো যাবে। একাধারে দুই বছর ইজারা মূল্য পরিশোধ না করলে এবং প্লট নেওয়ার পর তিন বছরের মধ্যে ইয়ার্ডের কার্যক্রম শুরু করতে না পারলে ইজারা বাতিল করা যাবে।

সর্বশেষ খবর