সোমবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

আরও ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা

জিন্নাতুন নূর

আরও ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা

বাংলাদেশে বছরে একাধিকবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত হানার শঙ্কা রয়েছে। এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন কিছুটা হলেও দায়ী বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। তাদের মতে, বছরে এক বা একাধিকবার ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত করতে পারে। আবার কোনো কোনো বছর তা একেবারে নাও হতে পারে।

গত এক দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০২২-এর অক্টোবর পর্যন্ত (২০১৮ সাল বাদে) প্রতিবছরই বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালেই তিনবার ঘূর্ণিঝড় হয়। আর চলতি বছর এ পর্যন্ত হয়েছে দুবার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষজনকে এখন থেকে বছরে একাধিকবার ঘূর্ণিঝড় হতে পারে- এমন প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। একই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। আবহাওয়াবিদরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা। বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছরই সাত-আটবার নিম্নচাপ তৈরি হয়। এর মধ্যে কোনটি শেষ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। এই ঘূর্ণিঝড় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভারতের ওড়িশা ও অন্ধ্র উপকূল এবং বাংলাদেশে আঘাত হানে। আবহওয়ার চক্রে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রবণতা কোনো কোনো দেশে হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। এক দশক ধরে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই একটি করে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। এর আগে আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেখা গেছে, তখন প্রতি তিন-চার বছরে একটি করে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানত। আবার ১৯৬০-এর দশকজুড়ে প্রায় প্রতিবছর একাধিক ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসেই দুটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানে। সাধারণত বৈশ্বিক আবহাওয়ার ধরন, ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির ক্ষমতা এবং বায়ুপ্রবাহসহ আবহাওয়াগত নানা বিষয় একত্রিত হয়ে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এই প্রভাবকগুলো কোনো কোনো দশকে প্রবল হয়ে ওঠে ঘূর্ণিঝড় বাড়িয়ে দিতে পারে, বা এটা অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ী রূপ নিতে পারে। এক্ষেত্রে এমনও হতে পারে বাংলাদেশে এখন থেকে প্রায় প্রতিবছর একটি বা একাধিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে। আর এ জন্য দুর্যোগ মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে এবং বোধগম্য করে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, বঙ্গোপসাগর হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা। আর এখানে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হবেই। সাধারণত বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে প্রতিবছর গড়ে পাঁচটি সাইক্লোন হতে পারে। এর চারটিই বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়। বছরের এপ্রিল, মে ও জুন এবং অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এই ঘূর্ণিঝড়গুলো সৃষ্টি হয়। সাধারণত সূর্যের তাপমাত্রা কোথায়, কখন এবং কী পরিমাণে পড়বে এর ওপর অনেককিছু নির্ভর করে। এবার জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস বৃষ্টি হয়নি। বর্ষাকালে এবার বেশ গরম অনুভূত হয়েছে। আবার সেপ্টেম্বরে বেশ বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা অক্টোবরে ছিল আরও বেশি। এগুলো ঘূর্ণিঝড় তৈরিতে প্রভাব রাখে। তিনি আরও বলেন, আবার কোনো কোনো বছর সাইক্লোন একেবারে নাও হতে পারে। বর্ষা মৌসুমে সাধারণত ঘূর্ণিঝড় হয় না। কখনো কখনো ঘূর্ণিঝড়ের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা আরও বেড়ে যাওয়ার কথা। তবে এর প্রভাবে এক বছর থেকে আরেক বছরে ঘূর্ণিঝড়ের ধরনে পরিবর্তন আছে। আর এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। সূর্য, বায়ুমন্ডলের পানি ও সমুদ্রের অবস্থানের কারণ অন্যতম। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে কাজ করা এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বছরে একাধিকবার ঘূর্ণিঝড় হলে তা মোকাবিলায় মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমগুলোতে গণমাধ্যমগুলো মানুষকে সচেতন রাখার ভূমিকা পালন করতে পারে। ঘূর্ণিঝড়কে আমরা ধ্বংস করতে পারব না। আবার প্রকৃতির ওপর চাপ তৈরি করলে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বায়ুমন্ডলে যদি এরোসলের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে তা ঘূর্ণিঝড় প্রবণতা বৃদ্ধি করতে পারে।

তিন দশকে বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় : দেশের ওপর গত তিন দশকে আঘাত করা ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে,  ১৯৯১ সালের ৩০ এপ্রিল এদেশের ওপর বয়ে যায় প্রলঙ্করী ঝড়। ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া সেই ঝড়  ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিবায়ু নিয়ে আছড়ে পড়ে চট্টগ্রাম ও বরিশালের উপকূলীয় এলাকায়। এতে দেড় লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৯৭ সালের ১৯ মে দেশের সীতাকুন্ডু ও এর আশপাশ এলাকায় আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ঘণ্টায় ২৩২ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সঙ্গে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা সে সময় প্লাবিত হয়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ‘সিডর’র আঘাতে বিধ্বস্ত হয় দেশের দক্ষিণ উপকূল। এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার। এতে ৩ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। ২০০৮ সালের অক্টোবরে ঘণ্টায় ৮৫ কিলোমিটার বেগের বাতাস নিয়ে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘রেশমি’। এতেও প্রাণহানি ঘটে। ২০০৯ সালে ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। এই ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নেয় দেশের প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণ। ২০১৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ এ প্রাণ হারান ১৭ জন মানুষ। ২০১৪ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘হুদহুদ’-এ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’-এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’র আঘাতে ২৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে ১১০ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে কক্সবাজারে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ ভারতের ওড়িশা উপকূলে আঘাত করার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কেড়ে নেয় নয়জনের প্রাণ। একই বছরের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত করার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এতে আটজনের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে ২১ মে প্রথমে সুপার সাইক্লোন  ‘আম্ফানে’ ১৫ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ২০২১ এর ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর প্রভাবে দেশের উপকূলের কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে ৭ থেকে ৮ ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হয়। এই বছরের সেপ্টেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ‘গুলাব’ ও ডিসেম্বরে ‘জোয়াদ’ আঘাত হানলেও দেশে তেমন বড় প্রভাব পড়েনি। চলতি বছরের ৯ মে প্রথমে ঘূর্ণিঝড় ‘আসানি’ বাংলাদেশে বেশ বৃষ্টিপাত ঘটায় আর সবশেষ গত ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় ভোলার কাছ দিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। এতে প্রাণহানিসহ উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর