তৈরি পোশাক শিল্পে সংকট কাটছে না। গত এক বছরে বন্ধ হয়েছে ছোট-বড় শতাধিক কারখানা-বায়িং হাউস। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভাবে কমেছে ক্রয়াদেশ। জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে। সবকিছু মিলে সংকটের মুখে পড়েছে পোশাক শিল্প।
অনেক কারখানা মালিক আর্থিক সংকটগ্রস্ত হওয়ায় শ্রমিকদের যথাসময়ে বেতন দিতে পারছেন না। বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্পে শতাধিক কারখানা পরিস্থিতির চাপে বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধের ঝুঁকিতে অনেকগুলো রয়েছে। শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়েছে। এতে যে কোনো সময় শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে।
পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেশ কিছু অর্ডার কমেছে। অনেক বায়ার তাদের অর্ডার হোল্ড করেছে। গ্যাস সমস্যার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। পোশাক বিক্রি কমেছে।
ফারুক হাসান আরও বলেন, সবকিছু মিলিয়ে আমরা নভেম্বর মাসের শেষে বলতে পারব কী পরিমাণ অর্ডার কমেছে। কতগুলো কারখানা বন্ধ হয়েছে তার সঠিক হিসাব আমার কাছে নাই। তবে আমরা সবাই চেষ্টা করছি কারখানা চালু রাখার। কারণ একবার বন্ধ হলে কারখানা ফের চালু করা অনেক কঠিন হয়ে যায়।
পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং কভিড-উত্তর বাতাবরণ অর্থনীতি টালমাটাল করে ফেলায় নতুন মাথাব্যথার কারণ হতে যাচ্ছে পোশাক শিল্প। মূল কারণ হচ্ছে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোর ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় গ্রাহক এসব দেশের বাজারে গত দুই মাসে ক্রয়াদেশ কমেছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। এসব বাজারে রপ্তানির জন্য পাইপলাইনে থাকা পণ্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। খুচরা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের পণ্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়া তার সর্বশেষ উদাহরণ। ইউরোপে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় ক্রেতাদের অন্যতম ওয়ালমার্ট।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল্লাহ আজিম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত এক বছরে গাজীপুরে ৪০ থেকে ৪৫টি পোশাক কারখানাসহ ঢাকা চট্টগ্রাম মিলিয়ে ৭৫ থেকে ৮০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ক্রয়াদেশ কমে গেছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে। সবকিছু মিলিয়ে সংকটের মুখে পড়েছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প। গত এক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ছোট-বড় শতাধিক তৈরি পোশাক কারখানা ও বায়িং হাউস।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চালানোর সক্ষমতা না থাকার অজুহাতে ১৫ নভেম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ধামরাইয়ের মম ফ্যাশন লিমিটেড। ১৭ নভেম্বর বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানার কর্ণফুলী সেতু এলাকার নিউ চর চাক্তাই সড়কের ডিপস অ্যাপারেলস লিমিটেডের তৈরি পোশাক কারখানার দুটি ইউনিট। ১৩ অক্টোবর এক দিনেই বন্ধ হয়েছে সাভারে ডাইনেস্টি গ্রুপের তিনটি পোশাক কারখানা। এভাবে গত এক বছরে শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএ।
এ বিষয়ে নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্ডার কমে গেছে ৩০ শতাংশ। গত দুই মাসে ১৫ শতাংশ শ্রমিককে চাকরি থেকে বাদ দিতে হয়েছে। কয়েকটি কারখানা বাধ্য হয়ে ৫-১০ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই করেছে।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, বড় সমস্যা ব্যাংক এলসি না খোলায় ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় সময়মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এলসি খোলা না গেলে কারখানা খোলা থাকবে কীভাবে। গত এক বছরে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ কারখানাই বন্ধের ঝুঁকি রয়েছে।
বিজিএমইএর নেতারা বলছেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানায় ৩ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি পোশাক পড়ে আছে। অর্ডারের পর পোশাক প্রস্তুত করা হলেও এখন হোল্ড করে রেখেছেন বিদেশি ক্রেতারা। এ অবস্থায় গভীর সংকটে পড়েছে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মতে, সার্বিকভাবে রপ্তানি আয় কমলেও অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের আয় ৩ শতাংশ বেড়েছে। এ পরিসংখ্যান অবাক করেছে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদেরও। গত অক্টোবরে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় ৩৬৭ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবরের ৩৬৫ কোটি ডলারের চেয়ে বেশি।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। যা মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ। এ খাতে এখন পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অদূর ভবিষ্যতে এর প্রভাব পুরো অর্থনীতিতেই পড়বে। পোশাক কারখানার ডাটাবেইজ প্রস্তুতকারক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাপড ইন বাংলাদেশের তথ্য মতে, দেশে ৩ হাজার ২১২টি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় ২৫ লাখ ৬৫ হাজার ৭৬১ শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে ৪২ শতাংশ পুরুষ আর ৫৮ শতাংশ নারী।