বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ঝুলে আছে সমঝোতা হতাশায় প্রবাসীরা

বাংলাদেশ গ্রিস চুক্তি

মতিউর রহমান মুন্না, গ্রিস

বাংলাদেশ ও প্রাচীন সভ্যতার দেশ গ্রিসের মধ্যে সমঝোতা চুক্তিটি বাংলাদেশ ও গ্রিক সংসদে অনুমোদন হলেও এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবায়ন হলে প্রথমে অনিয়মিতদের নিয়মিত করার প্রক্রিয়া শুরু করবে গ্রিক সরকার। এরপরই বাংলাদেশ থেকে মৌসুমি কর্মী নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হবে। গেল সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে অনিয়মিতদের বৈধ করার প্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল। এর আগে এমনটাই আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিল গ্রিসে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। কিন্তু চুক্তির পরও অনিয়মিতদের পুলিশি হয়রানি ও বাংলাদেশে বিতাড়িত করার খবর পাওয়া গেছে। তবে খুব শিগগিরই সমঝোতা চুক্তিটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধান হবে বলে আশাবাদী দূতাবাস।

জানা গেছে, ইউরোপের এই দেশটিতে বসবাস করেন প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি। গ্রিক সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৈধ অনুমতি নিয়ে দেশটিতে বসবাস করা বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। এর বাইরে অনেকে রয়েছেন যাদের বসবাসের অনুমতি নেই বা আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে। এমনকি অনেকেই এখনো আশ্রয় আবেদনেরই সুযোগ পাননি। তারা গ্রিক কৃষি ও রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন খাতে শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করছেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সফর করেন গ্রিক অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী নোতিস মিতারাচি। এ সময় তার মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইউরোপের দেশ গ্রিসে প্রতি বছরে ৪ হাজার করে বাংলাদেশি কর্মীকে মৌসুমি কাজের ভিসা দেওয়া হবে। এ ছাড়া একই আইনে সে দেশটিতে বসবাসরত ১৫ হাজার বাংলাদেশিকে বৈধতার আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ চুক্তিটি গেল জুলাই মাসে গ্রিক সংসদে অনুমোদন হয়। তখন জানানো হয়, খুব দ্রুতই গেজেট আকারে প্রকাশ হবে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া কী হবে সে বিষয়টি দুই দেশ মিলে ঠিক করবে।

তখন দেশটির অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়কমন্ত্রী নোতিস মিতারাচি জানিয়েছিলেন, ‘চুক্তির মাধ্যমে প্রতি বছর ৪ হাজার কর্মী মৌসুমি কাজে গ্রিসে আসার অনুমতি পাবেন। তারা প্রতি বছর নয় মাস করে টানা পাঁচ বছর কাজের অনুমতি পাবেন। চুক্তি অনুযায়ী এই ১৫ হাজার বাংলাদেশিকেও একই স্কিমের আওতায় নিয়মিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে তারাও সর্বোচ্চ পাঁচ বছর গ্রিসে থাকার সুবিধা পাবেন। পরে তারা সম্মানজনক একটি উপায়ে নিজেদের দেশে ফেরত যেতে পারবেন।’ জনা গেছে, এমন আইন নিয়ে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মাঝে দেখা দেয় হতাশা। প্রবাসীরা নয় মাস কাজ করে বাকি তিন মাস বাধ্যতামূলক দেশে যেতে চান না। প্রতি বছরে তিন মাসের জন্য দেশে থাকা অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার তাই এ আইনটি শিথিলের দাবি জানান প্রবাসীরা। যদিও এ আইন নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে বিতর্ক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রিসের সভাপতি আবদুুল কুদ্দুছ বলেন, ‘এ আইন পরে শিথিল হতে পারে। যেমন ১৯৯৮ সালেও এখানে অনিয়মিত বাংলাদেশিদের বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। তখন আইন ছিল প্রতি বছর শুধু নিজ দেশে দুই মাসের জন্য যাওয়া যাবে। কিন্তু এর ৫/৭ বছর পর কিন্তু সেখানে পরিবার নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।’

এদিকে এ চুক্তিটি গ্রিস সংসদে বিল পাসের পর অনিয়মিত বাংলাদেশিদের নিয়মিতকরণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানাতে গেল আগস্ট মাসের ১৮ তারিখ এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ দূতাবাস। এ সময় জানানো হয়, বৈধতার আওতায় আসতে হলে দুই বছরের বেশি মেয়াদ সম্পন্ন পাসপোর্ট লাগবে, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এর আগে গ্রিসে আগমন বা বসবাসের দলিল থাকতে হবে, নিজের একটি ই-মেইল অ্যাড্রেস থাকতে হবে, নিজ নামে নিবন্ধিত একটি মোবাইল নম্বর থাকতে হবে। যারা এরই মধ্যে তাদের সম্ভাব্য চাকরিদাতা নিশ্চিত করতে পেরেছেন তারা শিগগিরই দূতাবাসে গিয়ে তাদের নাম নিবন্ধন করে এবং তাদের পাসপোর্টটি সত্যায়িত করার জন্য বলা হয়। সভায় আরও জানানো হয়েছিল, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে গ্রিসে অনিয়মিতভাবে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়মিতকরণের কার্যক্রম শুরু হবে।

দূতাবাসের এমন ঘোষণায় প্রথম কয়েকদিন নিবন্ধন করতে দূতাবাস প্রাঙ্গণে ভিড় করেন প্রবাসীরা। তবে এক সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার ৫০০ বাংলাদেশি দূতাবাসে নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু এখনো গ্রিক সরকার কর্তৃক এর কার্যক্রম শুরু হয়নি। এরই মাঝে বেশ কয়েকজন অনিয়মিত বাংলাদেশি পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি আছেন। এ ছাড়াও গত ১৭ অক্টোবর রাতে একটি ফ্লাইটে গ্রিস থেকে আটজন অনিয়মিত বাংলাদেশি নাগরিককে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। এরপর থেকেই আতঙ্কে রয়েছেন অনিয়মিত বাংলাদেশিরা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপের দেশগুলো থেকে এমন অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসেডিউর্স চুক্তি হয়। এ চুক্তির আওতায় অনিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদের আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছিল, সেখানে বসবাসের অনুমতি ছিল না। গ্রিসের একটি ক্যাম্পে বন্দি থাকা মোহাম্মদ মোশাহিদ (ছদ্ম নাম) বলেন, ‘আমরা প্রায় এক বছর ধরে ক্যাম্পের ভিতরে মানবেতর জীবন যাপন করছি। আবেদন করেও মুক্ত হতে পারছি না। সব সময় একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকি কোন সময় আমাদের বাংলাদেশে ডিপোর্ট করে দেয়। কেউ আমাদের সহযোগিতা করছে না। আমাকে দেশে ফেরত পাঠালে শুধু আমার স্বপ্নই নয় আমার পরিবারের স্বপ্নকে নষ্ট করা হবে। কারণ যে টাকা ধারদেনা করে এসেছি তা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি, গ্রিসে এসেই পুলিশের হাতে আটক হয়ে ক্যাম্পে বন্দি আছি।’

এ ব্যাপারে গ্রিসে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ও গ্রিসের সমঝোতা স্মারকটি বাস্তবায়ন হলে প্রথমেই গ্রিসে বসবাসরত অনিয়মিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ করা হবে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে লোক আনার কার্যক্রম শুরু হবে। এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষা। তবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পার্লামেন্ট ও গ্রিক পার্লামেন্টে অনুমোদন হয়েছে। এখন প্রক্রিয়াগত কারণে কিছু দেরি হচ্ছে। তবে আশা করা যাচ্ছে খুব শিগগিরই এটা বাস্তবায়ন হবে এবং বৈধতার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফরম খুলে দেওয়া হবে। এরপরই এখানে অনিয়মিতভাবে থাকা বাংলাদেশিরা বৈধতার আওতায় চলে আসবেন।’ দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, গ্রিসের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ৭০০ বাংলাদেশি বন্দি রয়েছেন। ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় তারা আবেদন করতে পারবেন না। যাদের পাসপোর্ট নেই তারা বের হতে পারছেন না। তারা যাতে বেরিয়ে এসে আবেদন করতে পারেন সেজন্য দূতাবাস থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। যদিও আটককৃতদের সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে মনে করছেন অনেকেই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর