অষ্টম শ্রেণি পাস তানজিনা আক্তার ইভা ওরফে মেরি ওরফে মাহি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘ও লেভেল’ এবং ‘এ লেভেল’ পাস করে যুক্তরাজ্যের একটি আইটি ফার্মে কর্মরত রয়েছেন। টিকটক, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত পোস্ট দিতেন নিজের অর্ধনগ্ন ছবি ও ভিডিও। পরে টার্গেট ব্যক্তিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ফেলতেন প্রেমের জালে। ধনাঢ্য হলে করে ফেলতেন বিয়ে। পরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ এবং অডিওর কথোপকথন রেকর্ড করে ব্ল্যাকমেলের মাধ্যমে হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। তার এ প্রণয়ে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। বিয়ের ফাঁদে পড়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। যাদের মধ্যে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও রয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, মাহির সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন সম্প্রতি গ্রেফতার গাজীপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি রহমত আলীর ছেলে পরিচয় দিয়ে ৪০ নারীকে প্রেম-পরকীয়ার ফাঁদে ফেলা প্রতারক মো. মাসুম বিল্লাহ ফারদিন। দুজনে মিলে বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে নিঃস্ব করতেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে। রিমান্ডে ফারদিনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই রবিবার মাহিকে রাজধানীর ভাটারা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। দুই দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। ডিবি বলছে, টিকটক, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অর্ধনগ্ন ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতেন মাহি। পরে টার্গেট ব্যক্তিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে মেসেঞ্জারে মেসেজ দিতেন। পরে টার্গেট ব্যক্তির হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর নিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। একপর্যায়ে নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে নামিদামি হোটেলে লাঞ্চ বা ডিনারের আমন্ত্রণ জানাতেন। এভাবে সম্পর্ক গভীর হওয়ার পর টার্গেট ব্যক্তিকে কৌশলে স্ন্যাপচ্যাটের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে বলতেন।

 যারা স্ন্যাপচ্যাট চালাত না, তাদের স্ন্যাপচ্যাটে অ্যাকাউন্ট খুলে মেসেজ দিতে বলতেন। এরপর স্ন্যাপচ্যাটের মেসেঞ্জারে নিজের অর্ধনগ্ন ছবি পাঠিয়ে রসাত্মক আলাপে উদ্বুদ্ধ করতেন। কেউ তার ফাঁদে পা দিলে সব অডিও, ভিডিওর কথোপকথন রেকর্ড করে রাখতেন। পরে টার্গেটকে বিভিন্ন হোটেলে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাতযাপন করতেন। নিয়ে যেতেন বিভিন্ন স্পা সেন্টার, বার, নাইট পার্টি ও সিসা লাউঞ্জে। এরই মধ্যে তিনি নিজের স্বার্থ হাসিল করতে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, মাহির পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় ২০০৩ সালে এক বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে। কিন্তু তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য ২০১০ সালে ওই স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যায়। এর পরই লাগামহীন জীবনযাপন শুরু করেন। প্রথম স্বামীর ঘরে তিন সন্তান থাকলেও তাদের পরিচয় দেওয়া বাদ দিয়ে দেন। প্রথম স্বামীর সংসার চলমান থাকতেই বিভিন্ন লোকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান এবং প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন। বিয়ের পর প্রতারণা অব্যাহত রাখতে একে একে ১০টি বিয়ে এবং শতাধিক প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। বিভিন্ন নামিদামি হোটেলে রাতযাপন করতে থাকেন দেশি-বিদেশিদের সঙ্গে। তার প্রতারণার শিকার বিভিন্ন ব্যক্তি আইনি ব্যবস্থাও নিয়েছেন। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে পাঁচটি প্রতারণা মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র আরও জানান, ২০২২ সালে মাহির সঙ্গে পরিচয় হয় আলোচিত প্রতারক গাজীপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি রহমত আলীর ছেলে পরিচয় দিয়ে ৪০ নারীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করা মো. মাসুম বিল্লাহ ফারদিনের। পরে কয়েক দফা সাক্ষাতের পর তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং একসঙ্গে বেশ কয়েকবার রাতযাপন করেন। একপর্যায়ে তারা একে-অন্যের সহযোগিতায় প্রতারণার জাল আরও বিস্তার করেন। ফারদিন যাদের সঙ্গে প্রতারণা করতেন, তাদের সঙ্গে মাহিকে গাজীপুর সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। একই পরিচয় ব্যবহার করে অনেকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলিয়ে দিতেন। পরে প্রতারণার টাকা দুজনে ভাগ করে নিতেন।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আশরাফউল্লাহ বলেন, ১১ জানুয়ারি গ্রেফতার হওয়ার পর রিমান্ডে প্রতারক ফারদিনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাহিকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় মাহির কাছ থেকে র‌্যাব, নেভি ও বিমান বাহিনী লেখাসংবলিত আটটি ক্যাপ, ওয়াকিটকি সেট, ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা, তিনটি আইফোন, দুটি এটিএম কার্ড ও সিসা টানার সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মাহির ১০ বিয়ে ও শতাধিক লোককে প্রেমের ফাঁদে ফেলার তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আরও যাচাই-বাছাই চলছে।