সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

হারিয়ে গেছে ৩ শতাধিক নদ-নদী

উত্তরের দেড় হাজার কিলোমিটার জলপথ আর ফিরে পাওয়া যাবে না

নজরুল মৃধা, রংপুর

হারিয়ে গেছে ৩ শতাধিক নদ-নদী

রংপুরে নদী শুকিয়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। হয় ফসলের চাষ, চরানো হয় গরু -বাংলাদেশ প্রতিদিন

আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে দেড় হাজার কিলোমিটার হারিয়ে যাওয়া জলপথ আর ফিরে পাওয়া যাবে না। ভারতের একতরফা নদীশাসন, খরা মৌসুমে তীব্র খরা, বর্ষায় দুকূল উপচে বন্যা, আবার শীত মৌসুমে প্রচ- ঠান্ডা, প্রয়োজনের তুলনায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া, অপরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনসহ নানা কারণে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। গত ৫০ বছরে ছোট-বড় ৩ শতাধিক নদী এই অঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে। বর্তমানে কোনোরকমে বেঁচে থাকা শতাধিক নদী যৌবন হারিয়ে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে কৃষি, জনস্বাস্থ্য, প্রাণী, উদ্ভিদ হুমকির মুখে পড়েছে। নদীতে পানি না থাকায় জমিতে সেচ বাবদ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার বেশি। কমে গেছে গাছপালা।

রংপুর শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ১০টির মধ্যে ৭টি ইউনিয়নই তিস্তা নদী বেষ্টিত। শুকনো মৌসুমে তিস্তায় থাকে হাঁটুজল। ডালিয়া থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল চর। বগুড়ার প্রমত্তা করতোয়া এখন ক্ষীণ খালে পরিণত হয়েছে। তেমনি গাইবান্ধার ঘাঘট, কুড়িগ্রামের ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র- এসব নদী শুকনো মৌসুমে হেঁটে পার হওয়া যায়। পদ্মা নদীর ক্ষেত্রে একই অবস্থা। এখন  নদীর শোঁ শোঁ ডাক তো দূরের কথা, দুচোখ যেদিকে যায় শুধু বালি আর আর বালি। ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা শুকিয়ে অনেক স্থানে খালে পরিণত হয়েছে। অথচ এ অঞ্চলের মানুষের একসময় জীবন-জীবিকার নির্ভর ছিল নদীর ওপর। আবহমানকাল থেকে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল শত শত নদী। ভাটিয়ালী, মারফতি, মুর্শিদি গান গেয়ে পালতোলা নৌকার মাঝিরা নদীর প্রাণকে সজীব করে তুলতেন। কিন্তু আজকাল আর এসব দৃশ্য চোখে পড়ে না। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলের চার ভাগের তিন ভাগ নদীই মরে গেছে। মরা নদীতে জেগে ওঠা চরে গড়ে উঠেছে মানব-বসতি আর ফসলের জমি।

নদীবিষয়ক লেখক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, উত্তরের ১৬ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে একসময় চার শতাধিক নদী ছিল। এর মধ্যে ৩ শতাধিক নদীই হারিয়ে গেছে অথবা ভরাট হয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া ৩ শতাধিক নদীতে জলপথ ছিল দেড় হাজার কিলোমিটারের  ওপরে। এই জলপথ এখন রূপান্তরিত হয়েছে স্থলভূমিতে। এখনো শতাধিক নদী শুকিয়ে ক্ষীণধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদী দেখলে এখন আর কেউ মনে করে না যে একসময় এসব নদীর খরস্রোতা যৌবন ছিল। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার ও প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করায় কালের অতলগহ্বরে হারিয়ে গেছে নদীগুলো। যেখানে একসময় মাছের চাষ হতো এখন সেখানে চাষ হচ্ছে ধান, পাট, তামাকসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে নদী দিয়ে বয়ে চলা প্রাণের প্রবাহ থেমে গেছে। এসব নদী, উপনদী, শাখা-প্রশাখা নদী, ছড়া নদী, নালা নদী ও নদীখাত এখন শুধুই এ অঞ্চলের মানুষের কাছে স্মৃতি। তিস্তা অববাহিকা অর্থাৎ রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় ৮০টির বেশি নদী মরে গেছে। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় মরে গেছে ৪০টির বেশি নদী। অর্ধশতাব্দী আগে এসব নদীতে ছিল পানির প্রবাহ ও প্রাণের স্পন্দন। সূত্রমতে, উত্তরাঞ্চলে প্রকৃত রূপ থেকে হারিয়ে যাওয়া ৩ শতাধিক নদীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ধরলা, জলঢাকা, দুধকুমার, তিস্তা, স্বতী, ঘাঘট, নীলকুমার, বাঙ্গালী, বড়াই, মানাস, কুমলাই, লাতারা, ধুম, বুড়িঘোড়া, সোনাভরা, হলহলিয়া, লোহিত্য, ঘরঘরিয়া, ধরণি, নলেয়া, জিঞ্জিরাম, ফুলকুমার, কাটাখালী, সালমারা, রায়ঢাক, খারুভাজ, যমুনেশ্বরী, চিকলী, মরা করতোয়া, ইছামতী, আলাইকুমারী, মরা তিস্তা ইত্যাদি। একসময় তিস্তার শাখানদী হিসেবে ঘাঘট ও মানাস দাপটের সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রকৃতিকে শাসন করত। এসবের অনেক স্থানে নগরায়ণ হয়েছে। আবার অনেক স্থান পরিণত হয়েছে আবাদি জমিতে। ইতিহাস গবেষক জোবায়ের আলী জুয়েল জানান, উত্তরাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গভীর-অগভীর নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর