শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুরগির দামে চক্রাকার সিন্ডিকেট

খুচরা পাইকারি খামারি তিন পর্যায়েই অতিরিক্ত মুনাফা, উৎপাদন খরচের দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার, দুই মাসে কেজিতে দাম বেড়েছে ১২০ টাকা সিন্ডিকেটের পেছনে ৭ কারণ দেখছে ভোক্তা অধিদফতর

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

মুরগির দামে চক্রাকার সিন্ডিকেট

রাজধানীর রূপনগর আবাসিকের বেসরকারি চাকরিজীবী মহিউদ্দিন। শবেবরাতের দিন সকালে স্ত্রীর কথায় ১ হাজার টাকা নিয়ে দুই কেজি দেশি মুরগির মাংস কিনতে যান। বাজারে গিয়ে দেখেন এক সপ্তাহ আগেও যে মুরগি ৫০০ টাকা কেজি কিনেছেন, তা এক লাফে বেড়ে ৬০০ টাকায় উঠে গেছে! তিনি দেশি মুরগির বদলে দুই কেজি সোনালি মুরগি নিয়ে বাসায় ফিরেন। সেটিও ৪০০ টাকা কেজি দরে। ফেরার সময় এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘মধ্যবিত্তের পাতে এখন মুরগির মাংসও সোনার হরিণ!’

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত জানুয়ারিতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। সোনালি মুরগি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি এবং দেশি মুরগি বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি দরে। সেই ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজিতে বেড়ে বর্তমানে ২৬০ টাকায় উঠেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সোনালি ও দেশি মুরগির দামও। বর্তমানে সোনালি মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা, আর দেশি মুরগি প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় উঠে গেছে। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা।

মুরগির মাংসের দাম এত বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রূপনগরের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, তারা পাইকারি বাজার থেকে বেশি দরে কিনছেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা উত্তরবঙ্গ ও গাজীপুর মোকাম থেকে বেশি দামে কিনে আনছেন। খামারিরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পোলট্রি ফিডের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা মুরগির দামে প্রভাব ফেলেছে। তারা আবার দায় চাপাচ্ছেন করপোরেট কোম্পানিগুলোর ওপর। খুচরা থেকে পাইকারি, পাইকারি থেকে খামারি, খামারি থেকে করপোরেট কোম্পানি- মুরগির দাম বাড়ার পেছনে এ যেন এক চক্রাকার সিন্ডিকেট। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ফিডের দাম বাড়লেও আমাদের হিসাবে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ পড়ে ১৩৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড়শ টাকা। এটা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা কেজি দরে। সিন্ডিকেট না করে এত বেশি দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। উৎপাদন খরচের দ্বিগুণ দামে মুরগি বিক্রি হওয়ার কারণ খতিয়ে দেখার জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। বাজার পরিদর্শনে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মুরগির দাম বাড়ানোর পেছনে প্রকৃত অর্থেই একটি চক্রাকার সিন্ডিকেট কাজ করছে। এর সঙ্গে উৎপাদন খরচের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে খামারি, খামারি থেকে পাইকার, পাইকার থেকে খুচরা প্রতিটি পর্যায়ে মুরগির দাম নির্ধারণে ভূমিকা রাখে সিন্ডিকেট চক্র। তারা যে দাম ঠিক করে দেয়, সেই দামেই মুরগি বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে এসএমএস বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা হয়। আর মূল্য কারসাজি করতে নেতারা মুরগি কেনার ভাউচার বা মেমোও সংরক্ষণ করেন না। মুরগির মাংসের এই হঠাৎ দাম বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে সেখানেও সিন্ডিকেটের প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী সিন্ডিকেটের কারণে উৎপাদন খরচের অন্তত দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। গত ৬ মার্চ অধিদফতরের প্রতিনিধি দল রাজধানীর কাপ্তান বাজারে মুরগির (পাইকারি) দোকান পরিদর্শনে গিয়ে সাত ধরনের অনিয়ম দেখতে পান। পরে অনিয়মগুলো তুলে ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায় অধিদফতর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে মূল্য অস্থিতিশীলতার পেছনে যে কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে তা হলো- (১) বাজারে ২৮ থেকে ৩০টি মুরগির পাইকারি আড়ৎ আছে, (২) কোনো মুরগির দোকানেই মূল্য তালিকা নেই, (৩) দোকানিরা মুরগি কেনার পাকা রশিদ বা ক্যাশ মেমো দেখাতে পারেনি, (৪) মুরগি ব্যবসায়ীরা মূল্য তালিকা না টানানোর দায় সমিতির সভাপতির মর্মে জানান, (৫) তদারকির সময় মূল্য তালিকা না টানানোর জন্য সভাপতিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয় এবং (৭) মূল্য তালিকা না টানানো এবং পণ্য ক্রয়ের পাকা রশিদ বা ক্যাশ মেমো সংরক্ষণ না করার কারণে বাজারে মুরগির দামে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদন দেওয়ার পর মুরগির দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণ জানতে গতকাল পোলট্রি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভাও করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সভায় পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার স্বীকার করেন, ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয় এসএমএসের মাধ্যমে। তিনি এর দায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্য কারসাজি করে প্রান্তিক খামারিদের ধ্বংস করে দিচ্ছেন।

যখন প্রান্তিক খামারিদের হাতে মুরগি থাকে তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দাম কমিয়ে দিয়ে আমাদের ধ্বংস কওে দেয়। আর যখন আমাদের হাতে পণ্য থাকে না তখন তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। গুটিকয়েক করপোরেট কোম্পানির হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় মুরগির বাজার এখন অস্থিতিশীল। মূল সমস্যা করপোরেটের এই মেসেজ, ফেসবুক গ্রুপ- এটা বন্ধ করতে হবে। সভায় করপোরেট প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মসের এমডি ও ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী জাহিন হাসানের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তিনি জানান, তারা বাচ্চার উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ায় দাম বেড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর