স্যুয়ারেজের লাইন ও সেপটিক ট্যাংক বাড়ি ও ভবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু দিন দিন এটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যে, ২০২২ সালে সেপটিক ট্যাংক ও স্যুয়ারেজের লাইনের কারণে ২৫টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২৩ জন নিহত ও নয়জন আহত হন। অব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাসাবাড়ির স্যুয়ারেজ লাইন ও সেপটিক ট্যাংকে বিপদ ঘনিয়ে আসছে। এগুলো হয়ে উঠছে ‘টাইমবোমা’র মতো ভয়ংকর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্ধ সেপটিক ট্যাংকে বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতির বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা না থাকার কারণেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। এখন প্রায়ই সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এজন্য ট্যাংকে প্রবেশের আগে সেখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন আছে কি না নিশ্চিত হয়ে প্রবেশ করতে বলেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করার কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার হয় না। ম্যানুয়ালি সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ম্যানুয়ালি সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করা বেআইনি। বাংলাদেশে এখনো পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করে যাচ্ছেন।
জানা যায়, সেপটিক ট্যাংকে শ্বাস নিলে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে। হতে পারে মৃত্যুও। এর বাইরে ট্যাংকে ক্ষতিকর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। ট্যাংকের আবদ্ধ স্থানে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল না থাকায় প্রতিরক্ষামূলক গিয়ার ছাড়া সেপটিক ট্যাংকে শ্বাস বন্ধ বা বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারের আগে গ্লাভস, গগলস ও মুখোশ পরে সেখানে নামা উচিত বলে জানান। দুর্ঘটনা এড়াতে তারা প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর ট্যাংক পরিষ্কার করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন।
বহুতল ভবনগুলোর সেপটিক ট্যাংকে ভেন্ট পাইপ রাখার কথা থাকলেও তা রাখা হচ্ছে না। আলোবাতাস আসা-যাওয়ার পথের লাইন বা পাইপ বন্ধ করে তারই ওপর কাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এমনকি বাড়ির বেসমেন্টে কোনো কিছু নির্মাণ করার কথা না থাকলেও সেখানে দোকানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে গুদাম তৈরি করা হচ্ছে। এতে সেখানে স্যুয়ারেজ লাইন থাকলে তা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ছে। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে ভবনগুলোও বিপজ্জনক ‘টাইমবোমা’য় পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর সাইন্সল্যাবে সুয়ারেজ লাইনে জমে থাকা গ্যাস থেকে ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে জানান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রহমত উল্লাহ। ৫ মার্চ তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে আরও জানান, ঘটনাটি ২০২১ সালে মগবাজারের বিস্ফোরণের মতো গ্যাস থেকে সৃষ্ট বলে তারা ধারণা করছেন। তার মতে, জমে থাকা গ্যাসের মাত্রা যদি ৫ থেকে ১১ মাত্রার হয়, এটি যদি ট্রিগার করে তাহলে এ ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। এ ট্রিগার ফ্যানের সুইচ ও এসির সুইচের মাধ্যমেও হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সেপটিক ট্যাংক থেকে ফসজিন গ্যাস সৃষ্টি হলে বিস্ফোরণ হতে পারে। এজন্য মাঝেমধ্যে সেপটিক ট্যাংকগুলো পরিষ্কার করা দরকার। কিন্তু ভবন মালিকরা তা করেন না। ফলে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। দাহ্য কোনো কিছু এ গ্যাসের সংস্পর্শে এলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কোনো কারণে বৈদ্যুতিক লাইন, গ্যাসলাইনে লিকেজ হলেও বিস্ফোরণ হতে পারে। ঢাকা শহরে লাখ লাখ অরক্ষিত সু্যুয়ারেজের লাইন রয়েছে। সেখানে প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার টন মলমূত্র যোগ হয় এবং প্রচুর মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এ গ্যাস বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা না দিলে এটিও বিপদ ডেকে আনে। ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগের প্রকৌশলীরা জানান, বাসার নিচে তৈরি সেপটিক ট্যাংকের গ্যাস বের হয়ে যাওয়ার পথ না থাকলে সেখানেই জমে যাবে। তখন দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হবে। ১৬ মার্চ সাভারের আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানার সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে নেমে তিনজনের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা জানান, মূলত বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জি এম গোলজার হোসেইন বলেন, স্যুয়ারেজের লাইন বা সেপটিক ট্যাংক দুর্ঘটনা রোধে নিয়মিত ভবন মালিকদের এসব পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত। যদি তা না করা হয় তাহলে সেখানে গ্যাস জমা হবেই। যাকে আমরা বায়োগ্যাসও বলি। গ্যাস যখন দীর্ঘ সময় ধরে আটকা পড়ে তখন কখনো না কখনো এটি বের হবেই। আর তখনই বিস্ফোরণের ঝুঁকি তৈরি হয়।