বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রতারণার ফাঁদে সব হারিয়ে দিশাহারা

অভিযোগ দম্পতির বিরুদ্ধে, হয়েছে একাধিক মামলা

আলী আজম

মানুষের চাহিদা বুঝে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন এস এম রাশেদ রহমান ও শামীমা ইয়াসমিন নীলা দম্পতি। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে লোভনীয় চাকরির ব্যবস্থা করা, ঝামেলা ছাড়াই গাড়ি আমদানি করা, ব্যাংক থেকে বড় লোন পাইয়ে দেওয়া যেন কোনো ব্যাপারই নয় তাদের কাছে। চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিলেই মিলবে সবকিছু। অনেকেই তাদের ফাঁদে পা দিয়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়ে বর্তমানে নিঃস্ব হয়েছেন। অনেকে বছরের পর বছর এ দম্পতির পেছনে ঘুরে শুধু চোখের জলই ফেলে যাচ্ছেন। অভাবে পড়ে অনেকের সংসার ভেঙে গেছে। তবুও থামছে না এ দম্পতির প্রতারণা। ৫৩ লাখ টাকা প্রতারণা মামলায় গত বছর র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে আবারও শুরু করেছেন একই কাজ। ভুক্তভোগীদের অনেকে মামলা দায়ের করলেও এবং দুটি মামলায় সাজা হলেও তারা অধরা থেকে যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাশেদের স্ত্রী নীলার এক আত্মীয় বিচারাঙ্গনে কর্মরত থাকায় তারই ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তারা। হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, টাকা আদায়ে কেউ চাপ প্রয়োগ করলে পুলিশের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভয় দেখানো হয়। কেউ যদি হুমকিতে ভয় না পায়, তাহলে বিভিন্ন কর্মকর্তার পরিচয়ে ফোনে হুমকি-ধমকি দিতেই থাকেন তারা। এ দম্পতি ২০১৪ সাল থেকে ইতালি, কানাডা, রোমানিয়া, পর্তুগাল, জার্মান ও মাল্টাসহ অনেক দেশে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ভুয়া কাগজপত্র (ভিসা, কার্ড, টিকিট) সরবরাহ করে মানুষ ঠকিয়ে দিনের পর দিন অপকর্ম করে আসছে।

একই সঙ্গে রাশেদের এক স্বজনের সহযোগিতায় বড় অঙ্কের ব্যাংক লোন পাওয়ার ফাঁদ পাতেন তারা। তাদের আশ্বাসে লাখ লাখ টাকা খুইয়েছে অনেক পরিবার। গাড়ি আমদানির নামেও লাখ লাখ টাকা হাতাতেন তারা। তাদের এ গাড়ি আমদানির ফাঁদে পড়ে ২৫ লাখ টাকা খুইয়েছেন সরকারি এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। ব্যাংকলোনের ফাঁদে কুষ্টিয়ার মিরপুরের কাজিম আলী ১০ লাখ, একই এলাকার মনোয়ার হোসেন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও শারমিন আক্তার সাড়ে ৮ লাখ টাকা, ব্যাংকে চাকরি বাবদ চুয়াডাঙ্গার টিপু সুলতান সাড়ে ৮ লাখ টাকা খুইয়েছেন। এ ছাড়া রোমানিয়া যাওয়ার ফাঁদে ফরিদ আহমেদ, সাইফুল ইসলাম ও আতিকুর রহমান ১৮ লাখ টাকা, কানাডা যাওয়ার ফাঁদে পড়ে খোরশেদ আলম ও সোলাইমান নামে ২ জন ৪ লাখ টাকা খুইয়েছেন।

এ চক্রের খপ্পড়ে পড়া কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা রিফাত আরা রিমু বলেন, আমার স্বামীর এক বন্ধুর মাধ্যমে রাশেদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। আমরা জানতে পারি, রাশেদ একটি দূতাবাসে চাকরি করেন এবং দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠান। পরে আমার চাচা মফিজ আহমেদ ও চাচার এক বন্ধুকে ইতালি পাঠানোর জন্য কথাবার্তা আগানো হয়। ইতালিতে চাচার এক বন্ধু চাকরির ব্যবস্থা করতে চাওয়ায়, আমরা রাশেদের সঙ্গে চুক্তি করি বৈধভাবে শুধু ইতালি পৌঁছে দিতে হবে। এতে রাশেদ রাজি হয়ে জানায়, রোমানিয়া হয়ে আমার চাচা ও চাচার বন্ধুকে ইতালি পৌঁছে দেওয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে পাসপোর্ট, ভিসা লাগানো ও ইনড্রোস করানোর বাহানায় ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরই মধ্যে সে ইতালির তিন মাসের ভিসা পেয়েছে বলে ভুয়া কাগজ দেখায়। এমনকি ইতালির গ্রিনকার্ডও বের করে আনে আমার চাচার নামে। ইতালি পৌঁছানোর আগেই গ্রিন কার্ড দেখে আমাদের সন্দেহ হয়। পরে আমরা ভিসাসহ অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই করে দেখি সবই ভুয়া। পরে টাকা ফেরত চাইলে বেঁকে বসেন রাশেদ। দিতে থাকেন বিভিন্ন হুমকি। একপর্যায়ে ব্যাংকের চেক দিলেও সে একাউন্টে কোনো টাকা ছিল না। পরে তার বিরুদ্ধে আমি আদালতে মামলা দায়ের করি। যা চলমান রয়েছে।

রিফাত আরা রিমু আরও বলেন, আমার চাচা ইটভাটার ব্যবসায় লস খেয়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন। একমাত্র বাড়ি বিক্রি করে ৯ লাখ টাকা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমিও সরল বিশ্বাসে রাশেদকে টাকা দিয়েছিলাম। ফলে চাচা সব টাকা আমার কাছে ফেরত চাইছে। এ অবস্থার সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় পাব এত টাকা। আর কেউ যাতে এমন প্রতারণার শিকার না হয়, সে জন্য রাশেদ ও তার সহযোগীদের বিচার চাই।

রাশেদ-নীলা দম্পতির মাধ্যমে রোমানিয়া যেতে চেয়েছিলেন আলম সরকার নামের গাজীপুরের এক লোক। তিনি ওই দম্পতিকে ১৪ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তাকে রোমানিয়া পাঠানোর প্রলোভনে ভারতে পাচার করা হয়। আলম সরকার নিজের বাড়ি বিক্রি করে আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে পাচার চক্রের দাবিকৃত মুক্তিপণ দিয়ে তিন মাস পর দেশে ফিরে আসেন। এরপর ওই দম্পতির খিলগাঁও মান্ডা এলাকার বাসায় গিয়ে বাসাটি ফাঁকা দেখতে পান। তার মতো আর কেউ যাতে প্রতারণায় না পড়েন, সে জন্য এ দম্পতির বিচার দাবি করেছেন আলম সরকারও।

সর্বশেষ খবর