শিক্ষার্থীদের রংতুলির আঁচড়ে নতুন রূপে সেজেছে পুরো দেশ। ধুলো ও পোস্টারে ঢাকা অপরিচ্ছন্ন ফ্যাকাসে দেয়ালগুলো পরিণত হয়েছে রঙিন ক্যানভাসে। সেই ক্যানভাসে আঁকা চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহ ও প্রতিবাদ। দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের নানা স্মৃতি। ফুটে উঠেছে তারুণ্যের চোখে বৈষম্যহীন কাক্সিক্ষত স্বপ্নের বাংলাদেশ।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই দেশকে নতুনভাবে গড়ার কাজে হাত দেয় তরুণ সমাজ। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার পর্যবেক্ষণ, চাঁদাবাজ উৎখাত, দুর্নীতি রোধে বিভিন্ন সরকারি অফিসে নজরদারির পাশাপাশি আন্দোলন চলাকালীন যেসব অশোভন ও রাজনৈতিক স্লোগান লেখা হয়েছিল, নিজেরাই সেগুলো মোছার কাজে হাত দেন। ফলে কদিন আগেও যেসব দেয়ালে ছিল ঘৃণা ও দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ, এখন সেসব দেয়ালই নজর কাড়ছে নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশার আহ্বানে। দলবেঁধে জরাজীর্ণ ও পুরনো দেয়ালে থাকা পূর্বের লেখা মুছে বৈষম্যহীন স্বপ্নের বাংলাদেশকে আঁকছেন শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ভবনের দেয়াল, সীমানাপ্রাচীর, সড়কদ্বীপ, মেট্রো রেলের স্তম্ভ, উড়ালসড়কের স্তম্ভে গ্রাফিতির মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি ও নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তারা। তাদের সঙ্গী হয়েছেন অনেক অভিভাবক ও গৃহিণীও। গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের ৯ নম্বর সড়কের পাশের একটি দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মৌমিতা জান্নাত, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এআইইউবি) শিক্ষার্থী ফারিয়া নওশিন, ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির (আইইউবি) শিক্ষার্থী জাকিয়া সুলতানা, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) শিক্ষার্থী অন্তরাসহ কয়েকজন। তাদের সঙ্গে রংতুলি নিয়ে এঁকে যাচ্ছিলেন আবাসিক এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী সৈয়দা শাকিলা হায়দার। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আন্দোলনে শহীদদের মনে রাখার জন্য এ দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি আঁকছি। আমি এখন আর শিক্ষার্থী নই, তবে শিক্ষার্থীদের এ শুভকাজে নিজেকে ঘরবন্দি রাখতে পারিনি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে পরিচ্ছন্নতার কাজ করছি, নিয়মিত পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজখবর নিচ্ছি। নিজেরা ফান্ড তৈরি করে সাধ্যমতো সহায়তা করছি। মনের শান্তির জন্য কাজগুলো করছি। তবে আমরা এসব দেয়াল চিত্র আঁকার সময় আশপাশের বাসিন্দারা আমাদের পানি খাওয়াচ্ছেন। অনেকে খাবারও খাওয়াতে চাইছেন।
রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা, দোয়েল চত্বর, জগন্নাথ হল, ফুলার রোড, ঢাবির ভিসি চত্বর, টিএসসি, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, কাঁটাবন, বাটা সিগন্যাল, মিরপুর ১০ নম্বর, মগবাজার, খিলগাঁও, মহাখালী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে রাস্তার পাশের অধিকাংশ দেয়াল, উড়াল সড়ক, ভবনের দেয়ালগুলো নানা চিত্রকর্মে রঙিন হয়ে উঠেছে। এসব গ্রাফিতিতে অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি উঠে এসেছে সমাজের-রাষ্ট্রের সংস্কার, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, স্বৈরতন্ত্রের অবসান, বাকস্বাধীনতা থেকে শুরু করে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ।
শিক্ষার্থীদের এমন কাজে সাধুবাদ জানিয়ে অনেকেই তাদের পানি খাওয়াচ্ছেন। রং বা অন্য কিছু লাগবে কি না জানতে চাইছেন। তবে নিজেদের টাকাতেই তারা এ কাজ করছেন বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান। রাজধানীর পাশাপাশি দেশের প্রতিটা জেলা-উপজেলাকে তারুণ্যের রঙে রাঙাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গী হয়েছেন সাধারণ মানুষও। সরেজমিনে দেখা গেছে ‘তোমার ভয় নেই মুগ্ধ, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’; ‘একজন রিকশাচালকের সন্তানও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে’; ‘আমি সুপার বাংলাদেশ’; ‘জুলাই আমার আহংকার’; ‘পানি লাগবে, পানি’; ‘বুক পেতেছি গুলি কর’; ‘আয়নাঘর’; ‘চোখের পানি সঞ্চয় করলে দীঘি বানানো যেত’; ‘রক্তে কেনা বাংলাদেশ’; ‘নতুন দিনের নতুন সূর্য, জাগ্রত হউক বাংলাদেশ’; ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’; ‘শিক্ষক রাজনীতি নিপাত যাক, মেধা পাচার থেমে যাক’; ‘ছাত্ররাজনীতি নিপাত যাক, শিক্ষাঙ্গন মুক্তি পাক’; ‘চলো রাষ্ট্র সংস্কার করি’; ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’; ‘মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি’; ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারও বাপের না’- এমন নানা উক্তিসহ গ্রাফিতিতে বর্ণিল পুরো রাজধানী।