সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদেরও প্রয়োজনে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের কথা চিন্তা করলে দুই সিটিতে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছিল। তাই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত - অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ কাউন্সিলর আত্মগোপনে রয়েছেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিলেও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি কাউন্সিলরদের নিয়ে। দুই সিটির এই হযবরল অবস্থায় মশক নিধন থেকে শুরু করে প্রায় ১৪ ধরনের সেবা পেতে ভোগান্তিতে নগরবাসী।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস থেকে জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন, নাগরিক, চারিত্রিক, ওয়ারিশ, আয়, অবিবাহিত, দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ না হওয়া, পারিবারিক সদস্য, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সত্যায়িত সনদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রত্যয়নপত্র, প্রয়োজন ক্ষেত্রে অনাপত্তিপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা যাচাইসহ ১৪ ধরনের নাগরিক সেবার জন্য কাউন্সিলরকে স্বাক্ষর দিতে হয়। কিন্তু বর্তমানে কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে এসব সেবা বন্ধ রয়েছে। মশক নিধন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের তদারকিসহ টিসিবির পণ্য বিতরণ কাজেও ব্যাঘাত ঘটছে।
চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সিটির ৫৪ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৪৮ জন কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়ে অফিস করছেন না। মাত্র ছয়জন কাউন্সিলর নিজেদের কার্যালয়ে গিয়ে অফিস করছেন। ডিএনসিসির কামারপাড়া এলাকার ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম যুবরাজের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতীয় তলার কার্যালয় তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। কাউন্সিলর অফিসের নিচে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর থেকেই পলাতক রয়েছেন তিনি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দক্ষিণখান-আশকোনার ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান নাঈম গত ৪ আগস্ট থেকে এলাকাছাড়া। দক্ষিণখান এলাকার বাসিন্দা ছাব্বির হোসেন বলেন, ‘সম্পত্তি বাটোয়ারার জন্য ওয়ারিশ সনদ জরুরি। কিন্তু কাউন্সিলর না থাকায় কয়েকদিন ঘুরেও সনদ পাচ্ছি না।’ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন সড়কের ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজ অর্ধেক করে ফেলে রেখেছেন ঠিকাদাররা। যেসব আগে কাউন্সিলররা তদারকি করতেন। এখন তারা না থাকায় সেটির কাজ আগাচ্ছে না। উত্তর সিটির ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর পীরেরবাগ এলাকার কমিশনার গলিতে দেখা যায়, প্রায় এক মাস ধরে ড্রেনের ঢাকনা খুলে রেখেছে ঠিকাদাররা। মিরপুর এলাকার বেশির ভাগ ওয়ার্ড কাউন্সিলর লাপাত্তা। তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন সেবাপ্রার্থীরা। কাউন্সিলররা না থাকায় মশার ওষুধ ছিটানোর কাজেও কর্মীরা গাফিলতি করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৬৬ জনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আত্মগোপনে আছেন তারা। ওয়ার্ড সচিবদেরও একই অবস্থা। এসব ওয়ার্ডের বেশির ভাগ কার্যালয় ভাঙচুরসহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজটি করা হয়ে থাকে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে। এ কারণে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা এ সেবা পাচ্ছেন। কিন্তু বিভিন্ন সনদ নেওয়ার মতো বাকি যেসব সেবা কাউন্সিলর কার্যালয়কেন্দ্রিক, তা তারা পাচ্ছেন না। ডিএসসিসির গোর-ই-শহীদ মাজারের পাশে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস। ওই অফিসেও ৫ আগস্ট ভাঙচুর করা হয়। বর্তমানে অফিসটিতে দাপ্তরিক কাজ চালানোর মতো কোনো আসবাব নেই। আইডিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ হত্যার অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তারের পর দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে আছেন ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আটকে গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ছয়জনের মধ্যে চারজন কর্মী কাজ করছেন, বাকি দুজন কাজে যাননি। ছুটিতে আছেন ওয়ার্ডটির মশকনিধন কাজের তত্ত্বাবধানকারীও। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ সিটির বেশির ভাগ ওয়ার্ডের একই অবস্থা। উত্তর সিটির পরিস্থিতিও বেহাল। মহানগর প্রজেক্ট এলাকার বাসিন্দা জাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত এক মাসে সকালে কিংবা বিকালে কোনো মশক নিধন কর্মীকে লার্ভিসাইড ছিটানো কিংবা ফগিং করতে দেখিনি। মশার উপদ্রবে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভরা ডেঙ্গুর মৌসুমে বাসায় তিন মাসের শিশুকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ কাউন্সিলর আত্মগোপনে রয়েছেন। এতে নাগরিক সেবা বিঘিœত হচ্ছে। মেয়রদের সরিয়ে যেভাবে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, কাউন্সিলরদেরও সরিয়ে সব নাগরিক সেবা আঞ্চলিক কার্যালয়ে নিলে গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো থেকে নাগরিকরা বঞ্চিত হতো না। সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদেরও প্রয়োজনে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের কথা চিন্তা করলে দুই সিটিতে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছিল। তাই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত।’