শীত না এলেও প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও শীতের পদধ্বনির সঙ্গেই বায়ুদূষণের চোখ রাঙানি টের পাওয়া যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহের প্রথম চার দিন (১৯ থেকে ২২ অক্টোবর) ঢাকার বায়ুর মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ ছিল। এই অবস্থায় ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার মানুষ যারা ঘরের বাইরে কাজে বের হচ্ছেন, তাদের শ্বাস নেওয়াই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, অস্বাস্থ্যকর বাতাসের কারণে সর্দি-কাশি, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, বিষণ্নতা, নিউমোনিয়া ও ফুসফুস ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে মানুষ আগের থেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তারা বলছেন, শীত এলেই শিশু ও বয়স্কদের বায়ুদূষণের জন্য বেশি ভুগতে হচ্ছে।
বিশ্বের বায়ুদূষণের তালিকাতে এখন প্রায়ই ঢাকা প্রথম সারিতে থাকছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্যে বিশ্বের ১২১টি শহরের মধ্যে গতকাল সকাল ৯টায় বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল সপ্তম। এ দিন আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে ঢাকার স্কোর ছিল ১৬১। এর মধ্যে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার মধ্যে হেমায়েতপুর, আরামবাগ ও আইসিডিডিআরবি অফিস এলাকার বায়ু অপেক্ষাকৃত বেশি খারাপ ছিল। বাতাসের এই মান অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত। এর আগে গত ১৯, ২০ ও ২১ অক্টোবরও ঢাকার বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর। এই ধরনের বায়ু যে কোনো মানুষের জন্যই ক্ষতিকর। এতে বলা হয়, ওই সময় ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান ছিল অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫ এর উপস্থিতি। ঢাকার বাতাসে যার উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরিধানের পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে ঘরের জানালাও বন্ধ রাখার কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপত ডা. মো. আতিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে আছে হাচি, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। এ জন্য নতুন করেও অনেকে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার ধূলিকণার মধ্যে অনেক জীবাণু মিশে থাকে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন এবং শিশু ও বয়স্কদের নিউমোনিয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাতাসের মান খারাপ হলে শিশু ও বয়স্করা খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যেন না যায়। ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই সব বয়সিদের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সুষম খাবার খেতে হবে এবং ইনফøুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার টিকা নিতে হবে। পরিমিত বিশ্রাম ও কিছু শারীরিক ব্যায়াম চর্চা করতে হবে। এতে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট রিসার্চগেট-এ চলতি বছর প্রকাশিত ‘দ্য টেরিবল এয়ার পলিউশন ইন ঢাকা সিটি ইজ গেটিং ওরস’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবছরই ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে সড়কে পুরনো ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনে সৃষ্ট ধোঁয়া বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেনন্যাবল এনভায়নমেন্ট (সিএএসই) প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্যে, ঢাকায় ১০ দশমিক ৪ শতাংশ বায়ুদূষণে দায়ি অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা যানবাহন থেকে এবং ৭ দশমিক ৭ শতাংশ অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা সড়কের ধুলোবালি থেকে আসছে। বায়ুদূষণে আরও ভূমিকা রাখছে ডিজেলচালিত যানবাহন। ঢাকায় রাস্তা নির্মাণ. আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন বড় বড় স্থাপনার অবকাঠামোগত নির্মাণ চলতেই থাকে। এর মধ্যে ঢাকার মেট্রোরেল নির্মাণ এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের অবশিষ্ট নির্মাণকাজ, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ কাজের কারণে ঢাকার বাতাসে পিএম ২.৫ এর উপস্থিতি বাড়ছে। এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী পরিবহন ও সংরক্ষণে সঠিক নিয়ম মেনে কাজ পরিচালিত না হওয়ায় বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। এই গবেষণা আরও বলছে, ঢাকায় শীতকালে প্রতিদিন মাটিতে ৫০০ টন ধুলোবালি জমছে এবং ২ হাজার টন ধুলোবালি বাতাসে ভাসে। এ ছাড়া শহরের ভাঙা সড়কে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরার কারণে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি বাড়ছে। ঢাকার আশপাশের টেক্সটাইল ও ডায়িং কারখানাগুলোও বায়ুদূষণে অন্যতম ভূমিকা রাখছে। এরসঙ্গে ঢাকার বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত ডিজেলচালিত জেনারেটরও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি জানান, এবার শীত মৌসুম শুরুর আগেই সরকার বায়ুদূষণ কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সারা দেশে যত অবৈধ ইটভাটা আছে সেগুলো বন্ধ করা হবে। এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সহানুুভূতি দেখানো হবে না। নতুন করে আর কোনো ইটভাটার লাইন্সেসও দেবে না সরকার। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বছরের এই সময়টিতে বায়ুর মান বেশি খারাপ হয়ে যায়। সরকার অবৈধ ইটভাটাগুলো আগে বন্ধ করবে। এক্ষেত্রে ঢাকার চারপাশে যে অবৈধ ইটভাটা আছে সেগুলোতে মনোযোগ বেশি দেওয়া হবে। একই সঙ্গে নতুন কোনো ইটভাটাকে আর ছাড়পত্র দেওয়া হবে না। বিশেষ করে অবৈধ যে ইটভাটাগুলো বন্ধ করা হবে সেগুলো যেন নতুন করে আর চালু হতে না পারে সেটি দেখা হবে। পুরনো বাস ও ট্রাক যেগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই এবং ইকোনমিক লাইফ শেষ সেগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। পরিবেশ উপদেষ্টা সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির ফলে যে দূষণ হচ্ছে তা কমানো নিয়েও কাজ করবেন। আমরা একটি বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, ন্যাশনাল এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি করছি। এটি প্রায় চূড়ান্ত, শিগগিরই এটি উন্মুক্ত করা হবে। এ ছাড়া কঠিন যে বর্জ্য স্তূপ করে পোড়ানো হয় সেটিও বন্ধ করার চেষ্টা চলছে।