নির্মাণের ১৯ বছর পার হলেও জনবল সংকট ও বরাদ্দ না থাকায় পূর্ণাঙ্গভাবে এখনো চালু হয়নি বগুড়ার তিনটি হাসপাতাল। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে উপজেলা পর্যায়ে প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হাসপাতালগুলো চালু না হওয়ায় নানা দুর্ভোগে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা। আর জেলার কাহালু হাসপাতালে ৪৭ বছর আগের অ্যানালগ এক্সরে মেশিনে চলছে সেবা কার্যক্রম।
জানা যায়, জেলার আদমদীঘির সান্তাহার পৌরসভার রথবাড়ি, শিবগঞ্জের আলিয়ারহাট ও নন্দীগ্রাম উপজেলায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারিভাবে নির্মাণ করা হয় তিনটি হাসপাতাল। অবকাঠামো থাকলেও জনবল সংকট ও বরাদ্দ না থাকায় ১৯ বছর আগে নির্মিত ২০ শয্যা বিশিষ্ট এ তিনটি হাসপাতালে আজও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি চিকিৎসাসেবা। যে কারণে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব এলাকার লাখো মানুষ। জরুরি সেবা নিতে বহু পথ পাড়ি দিয়ে তাদের আসতে হচ্ছে জেলা শহরের হাসপাতালে। এতে করে নানা বিড়ম্বনায় পড়ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। তিন উপজেলার লাখো মানুষ তাদের কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এদিকে তিনটি হাসপাতালে অবকাঠামোসহ সব সুবিধা থাকলেও নেই শুধু পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা কার্যক্রম। খোলা রয়েছে শুধু বহির্বিভাগ।
বগুড়া জেলা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নন্দীগ্রাম উপজেলা সদরে হাসপাতাল নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ২৬ লাখ ৭৩ হাজার ১৬৮ টাকা।
প্রায় একই সময়ে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহারে ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই হাসপাতালের প্রাথমিকভাবে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৪২ হাজার ৪৮৮ টাকা। ২০০৮ সালে নন্দীগ্রামে হাসপাতালের জন্য ২৪টি পদ সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে এখানে কাগজে-কলমে একজন আরএমও, একজন মেডিকেল কনসালট্যান্ট, একজন মেডিকেল কর্মকর্তা, পাঁচজন সিনিয়র স্টাফ নার্স, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছেন। এ হাসপাতালে শুধু বহির্বিভাগ খোলা থাকে। হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীরা জানান, নিয়মিত বহির্বিভাগে রোগী দেখে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়। এখানে ভর্তি কিংবা অপারেশন করার সুযোগ না থাকায় তাদের জেলা সদরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের উন্নত চিকিৎসার লক্ষ্যে ২০০৫ সালে নির্মাণ করা হয় ২০ শয্যার আলিয়ারহাট হাসপাতাল। প্রথমে আধুনিক অপারেশন থিয়েটারসহ চিকিৎসাসেবার অনেক যন্ত্রপাতিই স্থাপন করা হয় হাসপাতালটিতে। কিন্তু সেবা চালু করা হয়নি। তবে সেখানে রোগী ভর্তি কার্যক্রম শুরু না হলেও চিকিৎসকসহ ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও লোকবল নিয়োগের অনুমতি না পাওয়ায় চালু করা যাচ্ছে না হাসপাতালটি। শুরুতে সেখানে কিছু লোকবল নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় ওষুধ বরাদ্দ ও পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় হাসপাতালটি চালু করা যায়নি। পরে নিয়োগ করা চিকিৎসকদের স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্ত করা হয়েছে।
২০০৪ সালে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে আদমদীঘি পৌরসভার সান্তাহারে হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজ শেষ না করেই ঠিকাদার বিল তুলে কাজ বন্ধ করে দেন। ২০১৯ সালে মন্ত্রণালয় আবারও ৩ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকায় হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টারসহ বাকি অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজ শেষ হয় ২০২১ সালে। এর পর চার বছর পার হলেও হাসপাতালটি চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে কাগজে-কলমে ৯ জনবল নিয়োগ দেওয়া হলেও সেখানে চিকিৎসক-নার্স কেউই দায়িত্ব পালন করেন না। মাঝেমধ্যে গেট খুলে বসে থাকেন ফার্মাসিস্ট। কেউ চাইলে তিনি দুই-একটি করে ওষুধ লিখে দেন। সান্তাহারে ৯ জন কাগজে-কলমে কর্মরত থাকলেও তাদের আদমদীঘি উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতালে সংযুক্ত করা হয়েছে। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট বগুড়ার কাহালু উপজেলা হাসপাতালে গত দুই বছর আগে একটি ডিজিটাল এক্সরে মেশিন বরাদ্দ হলেও স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের উদাসীনতায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা আজও হাতে পায়নি। দীর্ঘদিন ধরে অ্যানালগ পদ্ধতির ত্রুটিপূর্ণ এক্সরে মেশিন দিয়ে চলছে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম।
এ হাসপাতালে রোগীরা শুধু হাত ও পায়ের এক্সরে করতে পারলেও বক্ষসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের এক্সরে করতে পারছেন না। উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে এই হাসপাতালে একটি ডিজিটাল এক্সরে মেশিন না থাকায় রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
কাহালু উপজেলার এই হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রেডিওগ্রাফি আবদুর রশিদ জানান, ১৯৭৯ সাল থেকে ১০০ এম এ মিলিয়ন অ্যাম্পিয়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণ এক্সরে মেশিন দিয়ে কাজ চলছে। ৩০০ অথবা ৫০০ এম এ ডিজিটাল এক্সরে মেশিন এই হাসপাতালে জরুরি। পুরাতন এক্সরে মেশিন দিয়ে সঠিকভাবে কাজ করা যায় না।
কাহালু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ইনাম আহমেদ জানান, কাহালু উপজেলা হাসপাতালের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের বরাবরে বারবার আবেদনের মাধ্যমে একটি ডিজিটাল এক্সরে মেশিনের চাহিদাপত্র দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের শেষের দিকে একটি ডিজিটাল এক্সরে মেশিন এ হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ হলেও আজও বরাদ্দকৃত এক্সরে মেশিন হাতে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চোখের ও হৃদরোগের কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগীরা সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বগুড়া সিভিল সার্জন ডা. এ কে এম মোফাখখারুল ইসলাম জানান, ২০ শয্যার তিনটি হাসপাতালে শুধু বহির্বিভাগ চালু রয়েছে। সেখানে ছুটির দিন ছাড়া সব দিনই সেবা দেওয়া হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ আন্তবিভাগ চালু করতে জনবল ও বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।