জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আন্দোলন শেষ হলেও রেশ এখনো রয়ে গেছে। আন্দোলন ঠেকাতে সরকার এনবিআর ও কাস্টমস বিভাগের সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা করে। এ সার্ভিসের কেউ আন্দোলন করলে জেল-জরিমানার বিধান আছে। আবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আন্দোলনকারী এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতিসহ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে। এ ছাড়া নতুনভাবে আরও পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ-হয়রানির অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এর বাইরে নিচের পর্যায়ের এনবিআরের কর্মকর্তারাও আছেন বদলি আতঙ্কে।
সূত্রগুলো জানান, এনবিআরের আন্দোলন নিয়ে চরম অসন্তোষ ছিল সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে। ফলে আন্দোলন থামাতে কঠোর অবস্থান নেয় সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের আওতাধীন সব কাস্টম হাউস, বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনগুলোর চাকরিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এ ক্ষেত্রে কর্মবিরতি বা আন্দোলন করা যায় না। করলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। দুদকও বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে। অবশ্য সরকারের দাবি, এনবিআরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদককে তদন্তে নামাতে কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের সাবেক এক চেয়ারম্যান বলেন, দেশের রাজস্ব স্বার্থ সবার আগে। মে-জুন রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস। অন্য ১০ মাসে যত কর আদায় হয়, এ দুই মাসে তার চেয়ে বেশি আদায় হয়। আর এ সময় কর্মবিরতি, শাটডাউন, মার্চ ফর এনবিআর কর্মসূচি রাজস্ব আদায়ে বিঘ্ন ঘটে। অর্থনীতি এবং রাজস্ব আয়কে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে। মার্চ ফর এনবিআর পালন করবে জনগণ। কর্মকর্তারা এসব আন্দোলন কেন করবেন? এখন দুদকের অনুসন্ধানে যাঁরা আতঙ্কে আছেন তাঁরাও তো দেশকে আতঙ্কে ফেলেছেন। সৎ কর্মকর্তারা এসব থেকে রেহাই পাবেন, পক্ষান্তরে অসৎরা আটকা পড়বেন। দুই দিন আগে ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে এনবিআরের ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অভিযুক্তের বেশির ভাগই এনবিআরের আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। এনবিআরের অভিযুক্ত ছয় কর্মকর্তা হলেন আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম; নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার; ঢাকা-৮ কর অঞ্চলের অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা; ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা; ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কু ু এবং বিএসএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান।
এদিকে গতকাল এনবিআরের আরও পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আয়কর ফাঁকির সুযোগ দিয়ে নিজে লাভবান হয়েছেন। এভাবে রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। অভিযুক্তরা হলেন এনবিআরের করদাতা ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুর রশীদ মিয়া, এনবিআরের সদস্য লুতফুল আজীম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, উপকর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম ও যুগ্ম কমিশনার তারেক হাছান। দুদকের সহকারী পরিচালক তানজির আহমেদ জানান, ‘এনবিআরের অসাধু সদস্য ও কর্মকর্তারা কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও এনবিআর কর্মকর্তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য নির্ধারিত পরিমাণ কর আদায় না করে তাঁদের করের পরিমাণ কমিয়ে দিতেন মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতি বছর সরকার বিপুল রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মিথ্যা মামলা দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘অনেক করদাতা আগাম কর দেন। আবার কেউ কেউ বেশি কর দেন। নিয়ম হচ্ছে এ কর হিসাবনিকাশের পর বেশি দেওয়া হলে তা সংশ্লিষ্ট করদাতাকে ফেরত দিতে হয়। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, করের বাড়তি টাকা ফেরত পেতে অন্তত অর্ধেক টাকা ঘুষ বা উপহারে খরচ হয়। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর কর্মকর্তারা করের টাকা ফেরত দিতে নিজেরা মোটা অঙ্ক কামিয়ে নিচ্ছেন।’
দুদক সূত্র জানান, এনবিআরের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে।