এডিস মশার লার্ভা নিধনে কার্যকরী উদ্যোগ না নেওয়ায় বাগে আসছে না ডেঙ্গু। দেশে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। শুধু জুন মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং মারা গেছে ১৯ জন। জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত ছয় মাসে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই মারা গেছে ২২ জন। মশক নিধনে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কিছু জেলার পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা করছেন কীটতত্ত্ববিদরা।
ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নিধনে নেই কার্যকরী কোনো উদ্যোগ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নিয়মিত মশক নিধনে যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করে সেগুলোই চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরের অন্য সিটি করপোরেশনগুলোতে মশক নিধন চলে ঢিমেতালে। পৌরসভাগুলোতে মশক নিধনে সে রকম কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। কোথাও যন্ত্রপাতি নেই, কোথাও যন্ত্র আছে তো জনবল নেই। ডেঙ্গু আক্রান্তের দিক দিয়ে আলোচিত জেলা বরগুনা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরগুনার সরকারি হাসপাতালে শয্যার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। শয্যা সংকট হওয়ায় মেঝে থেকে শুরু করে বারান্দাতে পর্যন্ত রোগী রেখে চলছে চিকিৎসা। বরগুনার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৮৩৯ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে ২১৭ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। বরিশাল বিভাগের অন্য জেলাতেও বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা।
বরিশাল বিভাগের পাশাপাশি রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বেশ কিছু জেলায় বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। এর মধ্যে ঘটেছে মৃত্যুর ঘটনাও। আগে রাজধানী ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার বাইরে বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু রোগী।
দ্রুত বাড়তে থাকা ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত সোমবার অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে চারজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে বরগুনার হাসপাতালে দ্রুত পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া এ জেলার জরুরি রোগী আনা-নেওয়ায় দুটি অ্যাম্বুলেন্সও বরাদ্দ করা হয়েছে।
রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ৭০-৮০ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে অনেক আক্রান্ত রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়ায় তাদের হিসাব নেই অধিদপ্তরের কাছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত ছয় মাসে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই মারা গেছেন ২২ জন। আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনতে দেরি করায় অবস্থা জটিল হচ্ছে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এজন্য রোগীদের সুবিধার্থে ডেঙ্গু টেস্টের ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো যেন নিজেদের ইচ্ছামতো টেস্টের দাম রাখতে না পারে এজন্য টেস্ট ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এনএস১ টেস্টের মূল্য ৩০০ টাকা, আইজিজি এবং আইজিএম টেস্টের মূল্য ৩০০ টাকা এবং সিবিসি টেস্টের মূল্য ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি আমাদের সামনে এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদি এখনই মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের অনেক জেলায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বর্তমানে বরিশাল বিভাগ, বিশেষ করে বরগুনা ও বরিশাল জেলা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের গবেষণা ফোরকাস্টিং মডেল অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাজীপুর, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর ও মাদারীপুরে ডেঙ্গু ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করতে পারে। মে মাসের তুলনায় জুন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি এই আশঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করেছে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব জ্যামিতিক হারে বেড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’
ডেঙ্গুতে একজনের মৃত্যু হাসপাতালে ৩৮৬ জন : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরও ৩৮৬ জন। এ নিয়ে চলতি বছরে ১০ হাজার ৬৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হলো। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে মোট ৪৩ জনের। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুসংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তির তথ্যানুযায়ী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ৪৬ বছর বয়সি ব্যক্তি রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সিংহভাগই বরিশাল বিভাগের বাসিন্দা। এ বিভাগে মোট আক্রান্ত হয়েছে ১৬৩ জন। এর মধ্যে ৯৩ জনের বাড়ি বরগুনায়। অন্য বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭৩ জন। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩৮, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩০, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯, খুলনা বিভাগে ১৬, ময়মনসিংহ বিভাগে ৮ এবং রাজশাহী বিভাগে ৩৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ৩২২ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরে মোট ছাড়পত্র পেয়েছে ৯ হাজার ৪০৯ জন।
মাসভিত্তিক তালিকায় দেখা গেছে, এ বছর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে জুনে। এ মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ৯৫১। এ ছাড়া জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন।