রংপুরের কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হক পরকীয়া ও বন্ধুর বিশ্বাসভঙ্গের শিকার হয়েছিলেন। যার পরিণতিতে প্লাস্টিকের ড্রামে ২৬ খণ্ডের লাশ উদ্ধার হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার আশরাফুলের বাল্যবন্ধু জরেজুল ইসলাম ও তার প্রেমিকা শামীমা আক্তার প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানিয়েছে পুলিশ ও র্যাব। শামীমাকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, প্রেমিকাকে দিয়ে বন্ধু আশরাফুলকে ফাঁদে ফেলে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা ছিল জরেজুলের। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী আশরাফুলকে ঢাকায় আনা হয়েছিল।
আশরাফুলকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে টাকা আদায় করার টার্গেট ছিল জরেজুল ও তার কথিত প্রেমিকা শামীমার। কিন্তু টাকা না পেয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। শামীমাকে গ্রেপ্তারের আগে আশরাফুলের বন্ধু জরেজুলকে শুক্রবার রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জরেজুলকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, এটি আসলে একটি ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি।
এর আগে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হাই কোর্ট-সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে নীল ড্রাম থেকে খণ্ডবিখণ্ড লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ২৬ টুকরো লাশের আঙুলের ছাপ নিয়ে জানা যায়, এটি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী আশরাফুলের। পরে এ ঘটনায় নিহতের বোন আনজিনা বেগম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। মামলায় নিহত আশরাফুলের বন্ধু জরেজুলকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে রাতেই ডিবি পুলিশ কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে জরেজুলকে এবং র্যাব জরেজুলের প্রেমিকা শামীমা আক্তার ওরফে কোহিনুরকে একই জেলার লাকসাম থেকে গ্রেপ্তার করে।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. শফিকুল ইসলাম এবং র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফিন বলেন, জরেজুলের সঙ্গে শামীমার এক বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মালয়েশিয়া প্রবাসী জরেজুল মাস দেড়েক আগে দেশে ফেরেন। জরেজুলের দেশে ফেরার দিন শামীমাই তাকে ঢাকার বিমানবন্দরে রিসিভ করেন এবং পরে যে যার বাড়ি চলে যান। দেশে ফেরার পর দুজনের মধ্যে চলতে থাকা যোগাযোগের বিষয়টি জরেজুলের স্ত্রী ধরে ফেলেন। আর এ বিষয়ে সহায়তার জন্য তিনি দ্বারস্থ হন জরেজুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আশরাফুলের। তিনি আশরাফুলকে শামীমার ফোন নম্বর দিয়ে অনুরোধ করেন যেন আশরাফুল ফোন করে শামীমাকে জরেজুলের জীবন থেকে সরে যেতে বলেন। এর মধ্যে আশরাফুল শামীমাকে ফোন দেন এবং এক সময় তাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। তারা নিয়মিত কথা বলতেন ও ভিডিও চ্যাটিং করতেন।
পুলিশ ও র্যাব বলছে, আশরাফুলকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ১০ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব এবং সেটা দুজন ভাগ করে নেবে বলে শামীমাকে জানায় জরেজ। সেই পরিকল্পনানুযায়ী ১১ নভেম্বর জরেজ আশরাফুলকে নিয়ে ঢাকা আসেন। তাদের সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে রিসিভ করেন শামীমা। এরপর তারা তিনজন শনিরআখড়ায় একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। পরে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে আশরাফুলকে অচেতন করে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে জরেজ এবং ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা করে। ১২ নভেম্বর দুপুরে জরেজ ও শামীমা আশরাফুলের হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে এবং তিনি চিৎকার করতে থাকলে শামীমা তার মুখে ওড়না গুঁজে দিয়ে স্কচটেপ পেঁচিয়ে দেন। পরে জরেজ আশরাফুলকে হাতুড়ি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। অতিরিক্ত আঘাত এবং মুখ স্কসটেপ দিয়ে আটকানো থাকায় শ্বাস না নিতে পেরে ঘটনাস্থলেই আশরাফুল মারা যান। ১৩ নভেম্বর লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে জরেজ বাজার থেকে চাপাতি ও দুটি ড্রাম কিনে আনেন। এরপর চাপাতি দিয়ে লাশ ২৬ টুকরো করেন এবং দুটি নীল রঙের ড্রামে ভরে হাই কোর্ট এলাকায় ফেলে দেন। পরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তারা সায়েদাবাদ চলে যান। সেখান থেকে শামীমা নিজের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে চলে যান এবং জরেজ দাউদকান্দিতে পূর্ব পরিচিত একজনের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন।
বন্ধু জারেজুল ও প্রেমিকা পাঁচ দিনের রিমান্ডে : ২৬ টুকরা লাশ উদ্ধারের ঘটনায় নিহতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মো. জারেজুল ইসলাম ওরফে জরেজ (৩৯) ও তার প্রেমিকা শামীমা আক্তার ওরফে কহিনুরের (৩৫) পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল সন্ধ্যায় মামলার শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম ইসরাত জেনিফার জেরিনের আদালত এ আদেশ দেন। শুনানিকালে আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিল না। এ দিন সন্ধ্যায় আসামিদের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পুলিশ পরিদর্শক মো. আখতার মোর্শেদ।