দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল এক বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো এ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। সময়ের পালাবদলে পরে নির্বাচনকালীন এ সরকার নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক বাড়তে থাকে। এরপর ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে রদ করা হয়।
যে আওয়ামী লীগের আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেই আওয়ামী লীগই সরকারে এসে এ ব্যবস্থা বিলোপ করেছিল। গতকাল আবারও উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এসেছে। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
জানা যায়, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল এক বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি অনানুষ্ঠানিক অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ভোট হয়। সে নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে কোনোভাবেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, এ অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো তীব্র আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে। পরে প্রবল আন্দোলনের মুখে ওই বছরই ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সাংবিধানিক রূপ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের জন্য একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনা করবে। প্রধান উপদেষ্টা হবেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা যোগ্য কেউ না থাকলে পরবর্তী সিনিয়র বিচারপতি। সরকারের কাজ হবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন। এ ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এ সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচন দেয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এ পর্যন্ত চারজন ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করলেও তিনজনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালে ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। দেশে ২০০৬ সালের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কাঠামো নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়।
এ সময় রাষ্ট্রপতি মো. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হন। হরতাল-অবরোধসহ নানান কর্মসূচির কারণে রাজনৈতিক অচলাবস্থা আরও প্রকট আকার ধারণ করলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয় এবং একটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়, যা ‘১/১১ সরকার’ নামে পরিচিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। তিন মাসের জন্য ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলা হলেও এ সরকার দীর্ঘ দুই বছর ক্ষমতায় থেকে নিজেদের সাংবিধানিক এখতিয়ারের বাইরেও কাজ করে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। ওই রায়ে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অর্থাৎ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন অগণতান্ত্রিক এবং তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এরপর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে দেশের ভিতরে ও বাইরে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দিনের ভোট রাতে করা, একতরফা নির্বাচন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন, ‘আমি ও ড্যামি ভোট’, প্রশাসনিক কারচুপির অভিযোগ করা হয়।
গতকাল প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর ফলে নির্বাচনের সময় থাকবে তত্ত্বাবাধয়ক সরকার। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে। চতুর্দশ জাতীয় নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।