কোন সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ রোধে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাবটি পাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে আগামী মঙ্গলবার। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারকে কোনো মিলিটারি বা অন্য যেকোনো শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উৎখাতের চেষ্টাকে এ খসড়া প্রস্তাবে চরম নিন্দা জানানো হয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশ ‘এনজিও’র মাধ্যমে অন্য দেশে নাক গলানোর চেষ্টার বন্ধের একটি সংযোজনী আনার প্রস্তাব করেছে।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সেলিব্রিটি হল-এ রবিবার ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম অ্যাসেম্বলির দ্বিতীয় দিনে শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক আইপিইউর স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় দিনভর এ খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে বিপক্ষে তীব্র বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জানা যায়, চীন, ভারত, রাশিয়াসহ অনেক দেশে এ প্রস্তাবের পক্ষ নিলেও জি-১২ প্লাস গ্রুপ এ প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে প্রস্তাবের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি আইপিইউর। আগামীকাল (সোমবার) বিতর্ক শেষে খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। পরে আগামী মঙ্গলবার আইপিইউর সাধারণ এসেম্বলিতে খসড়া প্রস্তাবটি নিয়ে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রস্তাবটি গ্রহণ বা বাতিল করা হবে বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান আইপিইউর জনসংযোগ কর্মকর্তা। এ বিষয়ে রবিবারে ব্রিফিং-্এ উল্লেখ করা হয়, এর মাধ্যমে আইপিইউর সংসদীয় কূটনীতির বর্হিপ্রকাশ ঘটেছে। জানা যায়, প্রাণবন্ত বিতর্কে বিষয়টি এখন উন্নত দেশের সাথে উন্নয়নশীল দেশের কূটনৈতিক লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। জেনেভায় এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রণয়ণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
রবিবার কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি খসড়া প্রস্তাবে একটি সংযোজনী আনার প্রস্তাব করে বলেন, বর্তমানে অনেক দেশ ‘এনজিও’র মাধ্যমে অন্য দেশে নাক গলানোর চেষ্টা করে। এটি বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি দেশের নিজেস্ব স্বাধীনতা রয়েছে। ‘প্রতিটি দেশের অধিকার আছে নিজেকে শাসন করার এবং কীভাবে উন্নয়ন করবে সেটি ঠিক করার। তবে অনেক দেশ মনে করে তারা ইরাক বা সিরিয়াতে নাক গলানোর অধিকার রাখে এবং এর ফলে সে দেশে সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, প্রায় এক বছর আলোচনার পর এ রেজ্যুলেশনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি দেশ এ খসড়ার বিরোধিতা করেছে। তারা এটিকে বাতিল করার প্রস্তাব করেছে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, গ্রুপ-১২প্লাস জোটের মোট ৪৭টি সদস্য দেশ এ খসড়ার চরম বিরোধিতা করছে। এ জোটের সদস্য জার্মানি জানিয়েছে, ইতিহাসে শত শত নাক গলানোর উদাহারণ আছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নাক গলাতে হয়। তাই এ খসড়া বাতিল করা উচিত। একই সুরে কথা বলেছে ইউক্রেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইটজারল্যান্ড ও তুরস্ক। রাশিয়া ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া দখল করেছে। কিন্তু তারপরও অন্য দেশের নাক গলানো বন্ধের এ রেজ্যুলেশন বিরোধিতা করে ইউক্রেন জানিয়েছে, রাশিয়ার সংসদ ক্রিমিয়া দখলের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিল। তাই এ ধরনের খসড়ার কোন গুরুত্ব নাই। বেলজিয়াম বিরোধিতা করে জানিয়েছ, এটি ভারসাম্যপূর্ণ খসড়া নয়। অন্যদিকে তুরস্ক এই আইপিইউ সম্মেলনে এ খসড়া নিয়ে আলোচনা না করার আহ্বান জানায়।
এ খসড়া প্রস্তাব সমর্থন করে চীন বলেছে, বিদেশী শক্তি এবং এর প্রভাব গ্রহণযোগ্য নয়। ২০০৩ সালে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অজুহাত দেখিয়ে একটি দেশ ইরাক আক্রমণ করেছিল কিন্তু পরে দেখা গেছে সেখানে এ ধরনের কোন অস্ত্র নেই। রাশিয়া এ খসড়া সমর্থন করে জানিয়েছে, এটি বাতিল করা হলে সারা বিশ্বে একটি ভুল বার্তা যাবে। ভারতও এ রেজ্যুলেশন সমর্থন করেছে বলে জানায় বৈঠক সংশ্লিষ্ট সূত্র।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটির সভাপতি কর্নেল (অব:) ফারুক খান বলেন, আইপিইউ এর স্ট্যানডিং কমিটি-১ এ আলোচনাটা ছিল, আন্তর্জাতিক পিস এন্ড সিকিউরিটি নিয়ে জেনেভাতে পুর্ববতী আলোচনায় যে রেজ্যুলেশন তৈরি হয়েছে, ওই রেজ্যুলেশনের নিয়ে। বাংলাদেশসহ ৪০টি দেশ আলোচনায় অংশ নিয়েছে। রেজ্যুলেশনটা চেইঞ্জ করা দরকার। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো কোনো উন্নত শক্তিশালী দেশ কখনও দুর্নীতি, কখনও গণতন্ত্র, কখনও জঙ্গিবাদ বা কোনো একটা ছুতো ধরে কোনো কোনো দেশের মধ্যে ইন্টারভিন করে, হিউমেন রাইটসের নাম করে ইন্টারভিন করে এবং এরফলে ওই দেশের অবস্থা ভাল হয় না বরং সারা পৃথিবীর অবস্থা খারাপ হয়। তিনি বলেন, সুতরাং এ ইন্টারভিনের জায়গাটা বন্ধ করা দরকার এবং ওই সব দেশের মানুষের কালচারকে রেসপেক্ট করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গায় যে দুর্ভিক্ষ চলছে সে ব্যাপারটিও আলোচনায় এসেছে। এছাড়া আমরা একাত্তরে গণহত্যার কথা এবং রোহিঙ্গাদের কথা তুলে ধরেছি। সম্মেলনে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের মত এশিয়ান পার্লামেন্ট করা যায় কি না এমন একটা প্রস্তাব আসছে বলেও জানান তিনি। রাশিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ভারত, ভিয়েতনাম, চাঁদ, ফিলিস্তিন, থাইল্যান্ডসহ অংশ নেয়া ৪০টি দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে উন্নত দুই-একটা রাষ্ট্র রেজ্যুলেশনটা ভাল বললেও অধিকাংশ দেশই এটা পরিবর্তন করা দরকার বলে আলোচনায় বলেছে বলে জানান ফারুক খান।
ডা. দিপু মনি বলেন, এ খসড়াটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গত কয়েকবছর ধরে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান ক্রমাগত নাক গলিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানের সরকার ও তাদের জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদগুলো বিভিন্ন ধরনের বিবৃতি দিয়েছে ও রেজ্যুলেশন গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের সরকার এবং সুশীল সমাজ এর চরম বিরোধীতা করেছে। তিনি বলেন, সাবেক এ ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা যার মাধ্যমে ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে এবং দুই লাখ নারীকে অসম্মান করা হয়েছে সেটির কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ এটিকে সমর্থন করে। বাংলাদেশ অন্য দেশের কোন বিষয়ে নাক গলানোকে সমর্থন করে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র বিশেষ পরিস্থিতিতে যদি খুব প্রয়োজন পড়ে তবে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট নিয়ে ইন্টারফেয়ার করা যেতে পারে।’
বিডি-প্রতিদিন/০২ এপ্রিল, ২০১৭/মাহবুব