১৯ মে, ২০১৯ ১৯:১৮
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

গোপনে যেভাবে চলে হরিণের মাংসের ব্যবসা

অনলাইন ডেস্ক

গোপনে যেভাবে চলে হরিণের মাংসের ব্যবসা

ফাইল ছবি

পাঁচ মন হরিণের মাংস, দুটো হরিণের খুলি, আর চামড়া শনিবার উদ্ধার হয়েছে বরগুনা থেকে। হরিণ খুব একটা বড় প্রাণী নয়, তাই পাঁচ মন মাংসের জন্য সংখ্যায় দুটো নয় বরং আরও অনেক বেশি হরিণ মারা হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বরগুনার পাথরঘাটার পদ্মা-বনফুল গ্রামের একটি খালে ট্রলারে করে এসব মাংস নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হানিফ সিকদার। শিকারিদের কাউকে ধরা সম্ভব হয়নি।

যেভাবে কাজ করে চোরা শিকারীরা

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বলেন- কীভাবে এই চোরা শিকার করা হয়? তবে তিনি তার নাম প্রকাশ করতে চাননি। টেলিফোনে তিনি বলেন, তার যেখানে বাড়ি সেই গ্রামের সঙ্গেই লাগোয়া নদী। সেই নদীর ওপারেই সুন্দরবনের গহীন জঙল।

তিনি বলেন, 'মাছ ধরার পার্মিট-পাস নিয়ে এখান থেকে অনেকেই জঙলে যায়। তবে হরিণ শিকারিরা রাতের বেলায় গোপনে ঢোকে।'

নাইলনের দড়ির এক ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করেন তারা। সেই ফাঁদের বর্ণনা দিয়ে বলছিলেন, "হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে এগুলো পাতা হয়। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো আটকে যায়। এক রাতে পেতে আসা হয়। পরের রাতে গিয়ে আবার দেখা হয়।"

অনেক সময় একবারেই হরিণগুলো গলায় ফাঁস লেগে মারা পরে। আবার অনেক সময় পায়ে বেধে আটকে থাকে। এই ফাঁদের পদ্ধতির নামই স্থানীয়ভাবে ফাঁসি দিয়ে হরিণ মারা।

স্থানীয় বাজারে কিছুটা রাখঢাক রেখে হরিণের মাংস বিক্রি হয় বলে জানান তিনি। কিন্তু তাদের চোখ থাকে আরও দুরে সুদূর ঢাকা শহর পর্যন্ত। ছয় থেকে সাতশো টাকা কেজি দরে হরিণের মাংস অগ্রিম অর্ডারও নেয় শিকারীরা।

কোথায় এর নেটওয়ার্ক?

জাহিদুল কবির বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক। তিনি বলেন, মূলত চিত্রা হরিণই শিকার করা হয়। এই প্রজাতির হরিণই বাংলাদেশে সবচাইতে বেশি আছে।

হরিণের মাংস মূলত সুন্দরবন সংলগ্ন জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর এসব জেলা থেকে অথবা এই জেলার উপর দিয়ে আসে বলে জানালেন তিনি। নোয়াখালীর হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপে সরকারিভাবে হরিণ ছাড়া হয়েছে।

তাদের সংখ্যাও বেড়েছে। নোয়াখালী থেকেও হরিণের মাংসের নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। নৌ ও স্থলপথ দুভাবেই এটি বড় শহরে যায়।

কি পরিমাণে হরিণ মারা পরছে?

তিনি বলছেন, সরকারি হিসেবে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ হরিণ আছে সুন্দরবনে। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ (বর্তমানে ওয়াইল্ড টিম) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১১ সালে একটি জরিপ চালিয়েছিল।

তখন তাদের হিসেবে দেখা গেছে, বছরে ১১ হাজারের বেশি হরিণ নিধন হচ্ছে। কিন্তু এর পর নতুন করে কোনও জরিপ হয়নি। তবে এই হিসেব মানতে রাজি নন বন অধিদফতরের এই কর্মকর্তা।

তিনি বলছেন, 'এভাবে হরিণ মারা হলে এতদিন সুন্দরবনে হরিণ থাকতো না। সব শেষ হয়ে যেতো।'

তিনি জানান, ২০১৮ সালে শুধু সুন্দরবনের ভেতর থেকে প্রায় ৫০০ কেজির মতো হরিণের মাংস জব্দ করা হয়েছে।
মামলার রেকর্ডের ভিত্তিতে এই তথ্য দিয়েছেন তিনি। আনুমানিক দুশো হরিণ এভাবে মারা পরে বলে তিনি বলছেন। কিন্তু পাঁচটি জেলা থেকে আসে এর সরবরাহ। সবগুলো জেলা মিলিয়ে মাংসের পরিমাণ কত হবে সেই হিসেব পাওয়া যায়নি।

স্বেচ্ছাসেবক যা বলছেন

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, 'উৎসবের সময় হরিণ শিকার বেড়ে যায়। যেমন আসছে ঈদকে কেন্দ্র করে অনেক অর্ডার বাড়বে। আর সেগুলো বেশিরভাগই যাবে ঢাকার মানুষের ফ্রিজে। তবে স্থানীয় অনেক মানুষের বাড়িতেও পাওয়া যাবে।'

তিনি বলেন, এই পুরো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালীরা যাদের ভয়ে তিনিও নিজের নিরাপত্তার জন্য নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না।

তিনি আরও বলেন, আগে বন্দুক ব্যবহার করা শিকারি বেশি ছিল। এখন সেটা আর সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না।

হরিণের মাংস খাওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ

বাংলাদেশে আপনি হরিণের মাংস খাওয়ার জন্য অথবা শুধু ফ্রিজে রাখার জন্যেই জেলে যেতে পারেন অথবা বড় অংকের জরিমানা গুণতে হতে পারে আপনাকে।

বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের ধারা ছয় অনুযায়ী শিকারি, বিক্রেতা ও ক্রেতা সবাইকে শাস্তি দেয়া সম্ভব।

তিনি বলছেন, লাইসেন্স ও পার্মিট প্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে কোন বন্য প্রাণী, বন্যপ্রাণীর অংশ, অথবা তা থেকে উৎপন্ন দ্রব্য ক্রয়, বিক্রয়, আমদানি-রফতানি করেন, আর যদি অপরাধ প্রমাণিত হয় তাহলে সর্বোচ্চ এক বছরের, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তিন বছরের সাজা। অথবা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা। বাংলাদেশে হরিণ পালতে গেলেও সরকারি লাইসেন্স নিতে হয়। 

বিডি প্রতিদিন/১৯ মে ২০১৯/আরাফাত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর