অভিযোগপত্রের তুলনায় আদালতে নিষ্পত্তির হার অনেক কমে যাওয়ায় সারা দেশে মামলার জট ভয়াবহ হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে পুলিশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পুলিশ ৯২ হাজার ৭৫৩ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে। এ সময় আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৭ হাজার ১৪০টি মামলা। বিশেষ করে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে আদালতে মাত্র ৭৭২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেশের প্রতিটি আদালতেই মামলাজট ভয়াবহ হারে বাড়ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণসহ নানাবিধ কারণে আদালতে মামলার জট মারাত্মক হারে বেড়েছে। লকডাউনসহ নানা করণে অনেক দিন আদালত বন্ধ ছিল। করোনা সংক্রমণসহ বিভিন্ন কারণে অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে পারেননি। সশরীরে আদালত না বসায় অনেক ক্ষেত্রে ভার্চুয়ালি আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়েছে। এতে মামলার জট কিছুটা বেড়েছে। পরিবর্তিত সাক্ষ্য আইনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বা ভার্চুয়ালি সাক্ষ্য নেওয়া যাবে। এতে আদালতে দ্রুততার সঙ্গে মামলার জট কেটে যাবে বলে আমরা আশা করছি।’ পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৪২টি। একই সময় পুলিশ ৯২ হাজার ৭৫৩টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে ৮ হাজার ৪৬৭ মামলায়। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২৭ হাজার ১৪০টি। অভিযোগপত্রের তুলনায় মামলা নিষ্পত্তি কম হয়েছে ৪৬ হাজার ৪১৩টি।
এ ছাড়া বছরের প্রথম ৬ মাসে দেশে ডাকাতির মামলা হয়েছে ১৫৮টি। এসব ডাকাতিতে ৪৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের তথ্য পেয়েছে পুলিশ, যার মধ্যে ২৯টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এ সময় সারা দেশে হত্যামামলা হয়েছে ১৬৮৭টি। হত্যামামলার ৭৭ শতাংশ মামলায় পুলিশ আদালতে চার্জশিট দিয়েছে। কিন্তু চার্জশিটের তুলনায় ডাকাতি ও খুনের মামলা নিষ্পত্তির হার খুবই কম।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ৫ হাজার ২৩৮টি মামলা হয়েছে। পরের তিন মাসে মামলা হয়েছে ৫ হাজার ৩৭২টি। এসব নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার ৫৩ শতাংশ ধর্ষণ মামলা, ২৪ শতাংশ অপহরণ মামলা, ২১ শতাংশ যৌতুকের মামলা। নারী ও শিশু নির্যাতনের ৮৯ শতাংশ মামলার অভিযোগপত্র পুলিশ আদালতে দাখিল করেছে। কিন্তু নিম্ন আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় সাজার হার মাত্র ৭ শতাংশ বা তারও কম। তাছাড়া মামলায় নিষ্পত্তির হারও উদ্বেগজনক। ফলে প্রতিনিয়ত এসব মামলার জট বাড়ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা নিষ্পত্তি কম হওয়ার বিষয়ে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করা জরুরি। পুলিশ বিট পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে এবং বিট কর্মকর্তারা নারী ও শিশুদের সুরক্ষা বিষয়ে কাজ করছেন। সমন্বয়ের মাধ্যমে থানা ও আদালতে মামলার সংখ্যা কমানো গেলে আদালতেও মামলার জট কমে যাবে। আদালতে মামলার জট বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন ও প্লানিং) মো. হায়দার আলী খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কভিড সংক্রমণ বা অন্য যে কোনো সময় পুলিশের কার্যক্রম এক দিনের জন্যও বন্ধ ছিল না। থানায় কেউ অভিযোগ করলে পুলিশের কাজ হচ্ছে সঠিক তদন্ত করে সত্যতা পেলে অভিযোগপত্র দাখিল করা আর সত্যতা না পেলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া। আমরা তা-ই করছি।’ আদালতে মামলার জট কমাতে পুলিশের তেমন কিছু করার নেই উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মামলার বিচার কার্যক্রম চলাকালে আমরা সাক্ষী হাজির করা, সাক্ষ্য দেওয়া এসব কাজ করে থাকি। পুলিশ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিতভাবে এসব কাজ করছে। পুলিশের কারণে মামলার জট সৃষ্টি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
আদালতে মামলার জট বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী তুহিন হাওলাদার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে একটি মামলা চলতে থাকলে বা মামলার জট থাকায় বাদী এবং বিবাদী দুই পক্ষই হয়রানির শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তিতে আদালতের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের পথে অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে পারে।’
বিডি প্রতিদিন/হিমেল