কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জন্নাতুল বকেয়া নৌকা নিয়ে পেয়েছেন মাত্র ৯৯ ভোট। তৃতীয় ধাপের ৯৮৬টি ইউনিয়নের মধ্যে কোনো প্রার্থীর পাওয়া এটি সর্বনিম্ন ভোট।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার বেলগাছী ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সমীর কুমার দে পেয়েছেন মাত্র ১০২ ভোট। পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এইচ এম আর কে খোকন পেয়েছেন ১২০ ভোট। একই অবস্থা কক্সবাজারের পেকুয়ার মগনামা ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী নাজেম উদ্দিনের প্রাপ্ত ভোট মাত্র ১৪৫। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী তারা জামানত হারিয়েছেন।
তৃতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অধিকাংশ জায়গায় নৌকার চরম বিপর্যয় ঘটেছে। কোথাও দলীয় বিদ্রোহী, কোথাও স্বতন্ত্র প্রার্থীর আড়ালে বিএনপি, কোথাও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়ের চিত্র পাওয়া গেছে। এসব এলাকার অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের এমপি, আওয়ামী লীগের উপজেলা চেয়ারম্যান। টানা এক যুগে সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন সত্ত্বেও কেন এ বিপর্যয় তা আওয়ামী লীগের কাছেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তারা জানতে চাইছেন, এটা কি প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ত্রুটি, স্থানীয় সংগঠনের দুর্বলতা, না জাতীয় রাজনীতির কোনো প্রভাব। নাকি এমপি-মন্ত্রীদের পছন্দের প্রার্থী না হওয়ায় এ পরাজয়? নাকি মনোনয়ন বাণিজ্য? এ নিয়ে দলের সব পর্যায়েই এখন আলোচনা হচ্ছে। গতকাল বিকালে ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা অনির্ধারিত বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। উপস্থিত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কথাবার্তাতেই উঠেছে, নৌকার ভরাডুবির পেছনে এমপি লীগ বা ভাই লীগ, তৃণমূলের মনোনয়ন বাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বড় আকারে এই তিন কারণকেই দায়ী করছেন তারা।
মনোনয়ন বাণিজ্যে শোচনীয় পরাজয় : সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ৯টিতেই পরাজিত হয়েছে নৌকা। শান্তিগঞ্জেও প্রায় একই চিত্র। এখানে আট ইউনিয়নের দুটিতে মাত্র জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। নৌকার এমন ভরাডুবির পেছনে মনোনয়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন জেলা নেতাদের। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মনোনয়ন বাণিজ্য ও একতরফা মনোনয়ন প্রদানকেই এ পরাজয়ে দায়ী করছেন তারা। এ জেলায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের অনুসারী ও সহসভাপতি নুরুল হুদা মুকুটের নেতৃত্বে এক পক্ষ এবং জেলা সভাপতি মতিউর রহমান, সহসভাপতি মহিবুর রহমান মানিক এমপি ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমনের নেতৃত্বে আরেক গ্রুপ। দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে মান্নানের অনুসারীরা দলীয় মনোনয়ন পাননি। ফলে বিদ্রোহী প্রার্থী হয় অনেকেই। এতে ১০টি ইউনিয়নে নৌকার পরাজয় হয়। তৃতীয় ধাপেও একই ধারা অব্যাহত রাখে জেলা আওয়ামী লীগ। নিজ কেন্দ্রে জয়ী হওয়ার যোগ্যতা নেই এমন ব্যক্তিকেও মনোনয়নের জন্য কেন্দ্রে নাম পাঠানো হয়। সে কারণে তৃতীয় ধাপেও সদর ও শান্তিগঞ্জে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার হিড়িক পড়ে। সদর আসনের এমপি জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন। যে কারণে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও বিদ্রোহীদের কাছে নৌকার শোচনীয় পরাজয় হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নুরুল হুদা মুকুট বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ঢাকায় বসে কোনো কিছুর বিনিময়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়নের সুপারিশ করেছেন। দীর্ঘদিন দল করা ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিলে নৌকার ভরাডুবি হতো না। কিন্তু তারা মনোনয়ন বাণিজ্য করে অযোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ায় নৌকার বিপর্যয় হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, ‘তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতেই কেন্দ্রে তিনজনের নাম পাঠানো হয়। কেন্দ্র যাকে যোগ্য মনে করেছে, তাকেই নৌকা দিয়েছে। এখানে পছন্দ-অপছন্দ কিংবা বিনিময়ের প্রশ্নই আসে না।’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগে থেকে আওয়ামী লীগের ক্ষতি করার লোকের অভাব নেই।’ কক্সবাজারের পেকুয়ার মগনামা ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী নাজেম উদ্দিনের প্রাপ্ত ভোট মাত্র ১৪৫। এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন হলেও তার নৌকার মাঝি হওয়ার গল্প বললেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল এনাম। তিনি অভিযোগ করেন, কোটি টাকার মিশনে তিনি নৌকা বাগিয়ে এনেছেন। এলাকায় কোনো ধরনের প্রচারণাও করেননি। নৌকার প্রার্থীর বক্তব্য ছিল, যিনি নৌকা দিয়েছেন, তিনিই পাস করিয়ে আনবেন। নেতা-কর্মীর দরকার হবে না। মূলত আওয়ামী লীগ প্রার্থী হলেও বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ছিলেন নৌকার প্রার্থী।’ কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রাসেদুল ইসলাম তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে উনারা কেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা নৌকা মার্কার মনোনয়ন পেয়েছেন তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করি’।
এমপি লীগ/ভাই লীগে জয়-পরাজয় : তৃতীয় ধাপে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। উপজেলার নুরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নে সৈয়দ শাহীন আলম চশমা নিয়ে নৌকার বিপরীতে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি এবারের নির্বাচনে নৌকা চাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি ছাত্রলীগের নেতা ছিলাম। এখন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। নৌকা নিয়ে ভোট করে বিজয়ী হতে পারলে আরও বেশি ভালো লাগত। কিন্তু নৌকা চাইনি। কারণ আমরা স্থানীয় এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ভাইয়ের রাজনীতি করি। উনি বিগত নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। উনি যখন নৌকা নিয়ে বিজয়ী হবেন, আমরাও তখন নৌকা চাইব। নুরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নে নৌকা পেয়েছিলেন মীর আশরাফ আলী। তিনি বলেন, পুরো নির্বাচনী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি নিক্সন চৌধুরী। তার কূটকৌশলে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে। নেত্রকোনার পূর্বধলায় ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ২টিতে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। বাকি আটটিতে বিজয়ী হয়েছেন দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী। এ উপজেলায় আওয়ামী লীগ দুই ধারায় বিভক্ত। এক পক্ষের নেতৃত্বে স্থানীয় এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। আরেক পক্ষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। দলীয় মনোনয়নের সময় স্থানীয় এমপি আহমদ হোসেনের পক্ষের ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে নিজের পছন্দমতো প্রার্থীদের নাম কেন্দ্রে পাঠান বলে স্থানীয় অভিযোগ। একটি ইউনিয়ন বাদে ওই তালিকা অনুযায়ীই মনোনয়ন হয়। আহমদ হোসেনের অনুসারীরা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে তৃতীয় ধাপের ভোটে নৌকা ডোবাতে সক্ষম হন। এমনকি এমপির নিজ ইউনিয়ন বৈরাটিতে বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। তৃতীয় ধাপের ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবির প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, নৌকার পরাজয়ের কারণ খুঁজছি। কী কারণে নৌকা প্রার্থীর পরাজয় হলো, সেগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। যারাই নৌকার পরাজয়ের নেপথ্যে কাজ করছেন, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দল ও এলাকা কিংবা বংশগত ভোটের প্রভাব পড়ে। এ ছাড়াও দলীয় বিদ্রোহীদের কারণেও ভোটে প্রভাব ফেলেছে।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        