শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়। পাকিস্তান ও তাদের দোসরদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ স্মরণে দেশজুড়ে ৫০তম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শহীদদের স্মরণ করেন। পঞ্চাশ বছর আগে ১৪ ডিসেম্বর ঘাতক পাকসেনারা নতুন জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুদণ্ড ধ্বংসের লক্ষ্যে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে অন্তত ১০ জনের একটি দল বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীল নকশা তৈরি করেছিল।
দিবসটি উপলক্ষে এদিন দেশজুড়ে বিভিন্ন এনজিও, সামাজিক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় নেতাদের উদ্যোগে বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করা হয়। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পাক সেনাদের অনুপস্থিতিতে বিচারের দাবিতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন যশোর, খুলনা ও ময়মনসিংহে গণস্বাক্ষর অভিযান চালায়। শিক্ষক, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে তরুণরা শহীদ পরিবারের প্রতি সংহতি প্রদর্শন করেন এবং পাক সেনা ও তাদের সহযোগীদের লজ্জাজনক অপরাধের কঠোর বিচার দাবি করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর প্রধান আলী হোসেন মনি যশোরের ডিসি, এসপি ও মেয়রদের নিয়ে গণস্বাক্ষর অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. জালাল উদ্দিন, অধ্যাপক শরীফ আতিকুজ্জামান, সহযোগী অধ্যাপক শংকর মল্লিক ও প্রেমানন্দ মণ্ডলকে খুলনায় সরকারি ব্রজলাল কলেজের গণস্বাক্ষর অভিযানে অংশ নেন। তারা স্বাধীনতা বিরোধী বিভিন্ন জোটের সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার করেন। পৃথকভাবে জেলায় জেলায় বিভিন্ন আলোচনা সভা ও মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
দেশের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ওয়ান বাংলাদেশ’-এর ব্যানারে পাক নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছে। এদিন রাজধানীর শাহবাগে সন্ধ্যায় এক আলোচনা সভার আয়োজন করে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাক আর্মি কর্তৃক বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যার ওপর তথ্যচিত্র উপস্থাপন করা হয়। যেখানে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ও তরুণরা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য সংসদ শাহবাগে বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যা নিয়ে একটি পথ নাটকেরও আয়োজন করে এবং শহীদদের স্মরণে ভিসি চত্বরে মোমবাতি প্রজ্বলন করে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পথ নাটকের আয়োজন করে ওপেন ডায়ালগ বাংলাদেশ। যেখানে শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা আনতে এবং ১৯৭১ সালে পাকসেনাদের ভূমিকা তুলে ধরতে গুলশান-১ ও ধানমন্ডির বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে পাক বাহিনীর হাতে বুদ্ধিজীবী হত্যার স্লাইড শো প্রদর্শিত হয়েছে। স্লাইড শোগুলোতে পাক সেনাদের হত্যাকাণ্ড তুলে ধরা হয় এবং এই গণহত্যার অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারের আহ্বান জানানো হয়।
এ সময় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এটাই ফুটে ওঠে যে স্বাধীনতার ৫০ বছরের এই সময়ে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। সেক্টর কমান্ডার ফোরামসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে বক্তারা জোর দিয়েছেন যে, স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখতে বাঙালি জাতির ওপর তাদের জঘন্য ও বর্বর অপরাধসহ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানি সেনাদের অনুপস্থিতিতে বিচারের সময় এসেছে।
খুলনায় বাংলাদেশ সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের স্বেচ্ছাসেবকরা ৫০টি মোটরসাইকেল নিয়ে একটি র্যালির আয়োজন করে। একই সংগঠন রাজশাহী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালীতে অনুরূপ কর্মসূচি পালন করেছে। এসব কর্মসূচিতে শত শত মানুষ অংশ নিয়েছেন। মাগুরায় একটি মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়, যাতে শহীদদের ছবি সম্বলিত ব্যানার ও পোস্টার হাতে শতাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের বিচারের দাবিতে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশ (জেপিএবি) মানববন্ধনের আয়োজন করে। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সামনে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে জেপিএবির দেড় শতাধিক নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনসাধারণ উপস্থিত ছিলেন। সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সিলেট স্বাধীনতা ফোরামের উদ্যোগে র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল হেলাল। এই কমর্সচিতে প্রায় তিনশ মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক