মাঠ প্রশাসনের শীর্ষপদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগের বয়সসীমা পাঁচ বছর কমানো হচ্ছে। বর্তমানে ডিসি পদে নিয়োগের সর্বোচ্চ বয়স ৫০ বছর নির্ধারণ করা আছে। নতুন নিয়মে এ পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার বয়স হতে হবে ৪৫ বছরের কম। ডিসি হতে হলে মাঠ প্রশাসনে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পদে কমপক্ষে পাঁচ বছর, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) হিসেবে দুই বছর এবং ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। উল্লিখিত বিধান রেখে ‘বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার এবং সরকারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য কর্মজীবন পরিকল্পনা নীতিমালা’র খসড়া চূড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। খসড়া নীতিমালাটি অনুমোদনের জন্য শিগগিরই প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে পাঠানো হবে। সচিব কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পরই এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে সরকার।
খসড়ার বিষয়ে নাম প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন সময়ে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও কমিটিগুলো একটি যুগোপযোগী সিভিল সার্ভিস গঠনের যেসব সুপারিশ করেছে, নীতিমালাটি তার আলোকেই তৈরি করা হচ্ছে। নিয়োগে মেধার প্রাধান্য, পদোন্নতিতে প্রশিক্ষণের ফলাফলের গুরুত্ব, স্বচ্ছ ও বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ায় পদোন্নতি প্রদান, উদ্ভাবনী কাজের জন্য পুরস্কার ও আর্থিক সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা থাকছে এ নীতিমালায়। এসডিজি-২০৩০ এবং ভিশন-২০৪১-এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ন্যায়নিষ্ঠ মেধাবী সৃজনশীল দক্ষ-নিরপেক্ষ প্রতিযোগিতামূলক ও জনমুখী সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য। ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে সরকারি সেবা প্রদানে একটি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও ব্যবস্থাপনাই এর উদ্দেশ্য।
যা আছে প্রস্তাবিত নীতিমালায় : এতে বলা হয়েছে- বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট রুলস-১৯৮১ অনুসারে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পর নিয়োগ চূড়ান্ত করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণে মেধাবীদের অগ্রাধিকার এবং মূল্যায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা রাখা হবে। চাকরিতে শিক্ষানবিশকাল হবে দুই বছর। সন্তোষজনক চাকরিকাল পূর্ণ হলেই কেবল চাকরি স্থায়ী করা হবে। সদ্য নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের যোগদানের পরপরই এক বছর ছয় মাসের আবশ্যিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ছয় মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমিতে আইন ও প্রশাসন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ছয় মাস প্রশাসন একাডেমিতে এবং কোর্সের ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চার মাস সংযুক্ত থাকবেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বিভিন্ন শাখার কাজের বিষয়ে ধারণা লাভ করবেন। ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্য সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে যারা সর্বোচ্চ ফল করবেন তাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশে পাঠানো হবে। চাকরি স্থায়ী হওয়ার তিন বছর পর সহকারী কমিশনার পদে ওইসব কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, যারা সাফল্যের সঙ্গে ভূমি জরিপ ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। চাকরির পাঁচ বছর পূর্তিতে সিনিয়র স্কেল পাবেন। সে ক্ষেত্রে সিনিয়র সহকারী কমিশনার, সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের কার্যাবলি-সংক্রান্ত একটি স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। চাকরি ছয় বছর পূর্তিতে ইউএনও পদে পোস্টিং দেওয়া হবে।
প্রস্তাবিত খসড়ায় আরও বলা হয়- উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবশ্যই অ্যাডভান্স কোর্স অন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কোর্স বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে। প্রশিক্ষণে বাস্তবধর্মী দাফতরিক সমস্যা সমাধান, ক্রিটিক্যাল রিজনিং, একক ও প্রেজেন্টেশন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য সিনিয়র স্টাফ কোর্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য পলিসি প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কোর্স (পিপিএমসি) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশেষায়িত জ্ঞান ও মানবসম্পদ তৈরির জন্য উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের জন্য নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক কাজের ধরন বিবেচনা করে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। যুগ্মসচিবদের মধ্য থেকে বিভাগীয় কমিশনার নিয়োগ করা হবে। তাদের সর্বোচ্চ বয়স হবে ৫২ বছর এবং এক বিভাগে দুই বছরের বেশি কেউ বিভাগীয় কমিশনার থাকতে পারবেন না। অতিরিক্ত সচিবদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হবে এবং তিন বছরের বেশি এক মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে পারবেন না। সরকার উপযুক্ত কর্মকর্তাদের সচিব পদে নিয়োগ দেবে। কমপক্ষে তিন বছর সচিব পদে চাকরি করা কর্মকর্তাকে সিনিয়র সচিব পদে পদায়ন করা হবে। মুখ্য সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব পদে পদায়নের ক্ষেত্রে তিন বছর সচিব পদে চাকরির অভিজ্ঞতার সঙ্গে মাঠ প্রশাসনে চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ ছাড়া নীতিমালায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে চাকরিকাল, কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদন, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে প্রাপ্ত নম্বর, শিক্ষাগত যোগ্যতা, শৃঙ্খলা প্রতিবেদন এবং সুপিরিয়র সিলেকশন বোডের্র (এসএসবি) মূল্যায়ন বিবেচনা করে নির্দিষ্ট নম্বর বণ্টনের বিধান রাখা হয়েছে। চাকরির ২০তম বছরে উপসচিব কিংবা যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পেতে ব্যর্থ কর্মকর্তাকে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উপসচিব বিংবা যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে সব ধরনের আর্থিক সুবিধাসমেত অবসরে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এ নীতিমালায়। তবে কোনো কর্মকর্তা চাকরিজীবনের ২০ বছরের মধ্যে উপসচিব কিংবা যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি না পেলে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে তাকে উপসচিব বা যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া যাবে। সরকার চাইলে চাকরির ২৫ বছর পূর্তিতে যে কোনো কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে পারবে। তবে এখনো এ ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল