কৃষি প্রধান বাংলাদেশে ফসল বাঁচাতে প্রতিনিয়তই নানা ধরনের রোগবালাইয়ের সঙ্গে লড়াই করতে হয় কৃষকদের। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব নতুন নতুন রোগবালাই নিয়ে গবেষণা যেমন করছে, তেমনি কীভাবে এগুলো প্রতিরোধ করতে হয় সেটা নিয়ে কৃষকদের সচেতন করছে।
কিন্তু গবেষকরা বলছেন, কিছু রোগ পুরাতন হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধরনের পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশে বিজ্ঞানীরা যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলকে রক্ষায় তাদের গবেষণায় বেশি গুরুত্ব দেন সেগুলো হচ্ছে- ধান, পাট ও গম।
আজ ১২ মে, ইন্টারন্যাশনাল ডে অব প্লান্ট হেলথ পালন করা হবে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন বলেছে, বিশ্বে যত খাদ্য মানুষ খায়, তার ৮০ শতাংশ আসে বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকে। তবে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত শস্য নষ্ট হয়ে যায় কীট-পতঙ্গ ও রোগবালাইয়ের আক্রমণে।
বাংলাদেশে এমনি পাঁচটি ফসলের রোগের কথা উল্লেখ করা হলো- যেগুলোর আক্রমণে প্রতিবছর ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীম শামছি বলেন, ধানের ব্লাস্ট রোগটি নতুন নয়, কিন্তু নতুন নতুন যেসব ধরণ বা ভ্যারিয়েন্ট এসেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কীটনাশক আর কাজ করে না।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট বলেছে, ধানের ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত মারাত্মক ক্ষতিকারক রোগ। বোরো ও আমন মৌসুমে সাধারণত ব্লাস্ট রোগ হয়। অনুকূল আবহাওয়ায় এ রোগের আক্রমণে ফলন শতভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
চারা অবস্থা থেকে শুরু করে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় রোগটি দেখা দিতে পারে। এটি ধানের পাতা, গিট ও নেক বা শীষে আক্রমণ করে থাকে।
ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট বলেছে, প্রাথমিক অবস্থায় নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ সহজে ধরা যায় না। যখন ধরা পড়ে, তখন জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। সেসময় অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করলেও কার্যকরভাবে রোগ দমন করা সম্ভব হয় না।
সেজন্য কৃষকদের আগাম সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ধানের টুংরো ভাইরাস:
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে ধানের ব্যাপক চাষ হয় এবং এ অঞ্চলে বিশেষ করে সীমান্ত এলাকাগুলোতে কৃষকদের মধ্যে স্বর্ণা ধানের জাত ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। এখন গবেষকরা বলছেন, যেসব এলাকায় এ ধানের জাত বেশি চাষ হচ্ছে সেখানেই টুংরো ভাইরাসের আক্রমণ বেশি হতে দেখা যাচ্ছে।
ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, এ ভাইরাসটির ওষুধ নেই, তাই প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নাজমুল বারী বলেছেন, অল্পকিছু গাছ আক্রান্ত হলেই সেগুলো উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে বা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। আর পোকাটিও মেরে ফেলতে হবে।
এ ছাড়া হাত জাল দিয়ে বা অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করে সবুজ পাতা ফড়িংদমন করতে হবে। আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতাফড়িং মেরে ফেলা যায়। টুংরো আক্রান্ত জমির আশে পাশে বীজতলা করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি।
গমের ব্লাস্ট রোগ:
বাংলাদেশের গম গবেষণা ইন্সটিটিউট বলছে ২০১৫-১৬ সালে দক্ষিণাঞ্চলের সাতটি জেলায় প্রথম গমের ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। যশোর-মেহেরপুর থেকে শুরু করে বরিশাল-ভোলা পর্যন্ত এ রোগ ছড়ায়। এটা ঠেকানোর জন্য অ্যাকশন প্ল্যান নেয়া হয় এবং সাময়িকভাবে গম চাষ নিরুৎসাহিত করা হয়।
বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই ধানে এ সংক্রমণ দেখা গেছে। ফলে প্রথমে মনে করা হয়েছিল যে ধান থেকেই হয়তো এটা গমে ছড়িয়েছে।
ইন্সটিটিউট বলেছে, ব্রাজিল থেকে একবারই কিছু গম আনা হয়েছিল এবং তা নিম্নমানের বলে কিছুটা ফেরত পাঠানোও হয়েছিল। তবে তা খাবার গম, বীজ নয়। তবে এ নিয়ে তারা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রথম বছর ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে এই ব্লাস্ট সংক্রমণ হয়। কোনো কোনো ক্ষেতে ৯০ শতাংশ গমের ক্ষতি হয়েছে, তবে গড়ে ক্ষতি হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এর পরের বছরও এই রোগ ঠেকানোর জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়, এবং ক্ষতি ৫ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়।
অধ্যাপক ড.শামীম শামছি বলেন, গমের এই রোগ ব্যবস্থাপনায় এখনো কোন সমাধানে আসা সম্ভব হয়নি।
পাটের কাণ্ড পঁচা:
গবেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধান একটি অর্থকরী ফসল পাটের কাণ্ড পঁচা রোগটার জন্য পাট গাছ পুরোটা মারা যায়। পাট গাছের জীবনকাল ৭-৮ মাসের। যখন পূর্ণ বয়সের দিকে আসে এবং ফুল ফোটা শুরু করে তখনি পাটের আঁশে জমাট বেঁধে যায়।
অধ্যাপক ড.শামীম শামছি বলেন, ‘এটাকে স্টেম রট অব জুট বলা হয়। এটা এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে পাটকে বাঁচাতে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কোন সমাধানে আসা যায়নি।’
পাউডারী মিলডিউ:
লাউ, শসা, কুমড়া জাতীয় যেসব উদ্ভিদ রয়েছে তাদের এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণের শিকার হয় যেটাকে বলে পাউডারী মিলডিউ। এসব গাছে পাতায় সাদা পাউডারের মত হয় এবং এক পর্যায়ে গাছটায় মরে যায়। এটার এখন পর্যন্ত কোন ফলপ্রসূ কোনো ব্যবস্থাপনা নেই বলে গবেষকরা বলেছেন।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ