ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল সপ্তম শতাব্দীর প্রথম শতকে। ৭০০ বছর ধরে মুসলমানরা জ্ঞানবিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বীকার করতেই হবে, আড়াই হাজার বছর আগেও জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। গ্রিসে ঘটেছিল ক্লিউবুলাস, সোলেন, চিলোন, বিয়াম, হেলিম, পিটাকাস, পেরিয়ান্ডার, প্লেটো, সক্রেটিস ও এরিস্টটলের মতো মহাজ্ঞানীর আবির্ভাব। ভারতবর্ষে জন্ম নিয়েছিল আর্য ভট্টের মতো মহাপুরুষ। গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় যিনি জগৎবাসীর কাছে আলোকবর্তিকা হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারেন। গণিত বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ‘শূন্য’ সম্পর্কে ধারণা দেন এই মহান গণিতবিদ। এ কথা ঠিক, ব্যাবিলন ও মায়া সভ্যতার সময়ও শূন্যের চর্চা ছিল বলে অনুমান করা হয়। সেই প্রাচীনকালে মৌর্য সাম্রাজ্যের মহান সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের আমলে চাণক্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চায় যে অবদান রেখেছেন, তা এখনো প্রাসঙ্গিক।
ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়ের সময় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মানব সভ্যতা এক দুঃসময় অতিক্রম করছিল। সে দুঃসময়ের অবসান ঘটায় মুসলমানদের জ্ঞানচর্চার স্পৃহা। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম একেকটি সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিটি ধর্মের অবদান অনস্বীকার্য। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’। বেদের প্রতিশব্দ জ্ঞানার্থ, সত্যার্থ, বিচারার্থ ইত্যাদি। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মগ্রন্থ ‘বাইবেল’-এর ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্ট। বাইবেল শব্দটির অর্থ বই। এই অভিধাটি অনুসারীদের জ্ঞানের আলোকে আলোকিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলামের পবিত্র গ্রন্থের নাম ‘কোরআন’। যার অর্থ পঠিত বা পাঠের বিষয়। কোরআনের প্রথম বাণী ‘ইকরা’ শব্দের অর্থ পড়ো। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এই শব্দটি প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে। ইকরা বা পড়ো এই তাৎপর্যপূর্ণ শব্দটি মুসলমানদের মানসজগতে জ্ঞানচর্চার যে তাগিদ সৃষ্টি করে, তা সত্যিকার অর্থে এক বিশ্ব বিপ্লবের ঘটনা।
ইতিহাসবিদ পি. কে হিট্টির মতে, ‘অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত আরবি ভাষাভাষী লোকেরা সমগ্র বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলোর দিশারীতে পরিণত হন। তাঁদের মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞান ও দর্শন এমনভাবে পুনরুজ্জীবিত, সংযোজিত ও সম্প্রসারিত হয় যে এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর উন্মেষ সম্ভবপর হয়।’ ওই সময়ের মুসলিম মনীষীদের উদ্ভাবনী মেধা জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উদ্ঘাটন করে। বর্তমান বিশ্ব আজও তাদের অসামান্য জ্ঞান ও প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মুসলিম অবদানের সুখ্যাতি করে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ব্রি ফল্ট বলেছেন, ‘বিজ্ঞান আরব সংস্কৃতির কাছে বিশেষভাবে ঋণী।’
ইবনে সিনা মধ্যযুগের জ্ঞানবিজ্ঞানের এক অসাধারণ নাম। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা চিকিৎসাবিদ। চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর অবদান আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্মেষে অবদান রেখেছে। ইবনে সিনার ‘কানুন’ ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলে অভিহিত করা হয়। শল্যবিদ্যা সম্পর্কেও এটি ছিল একটি বিশ্বকোষ। ইবনে সিনার কানুন সম্পর্কে অধ্যাপক হিট্টি বলেছেন, কানুনের আরবি সংস্করণ ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে রোমে প্রকাশিত হয় এবং সেটা ছিল প্রারম্ভিক যুগের একটি মুদ্রিত গ্রন্থ। আবুল কাশেম আল বুকাছিম, ইবনে রুশদ ছিলেন সেই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী।
জ্যোতির্বিদ্যায় মুসলমান বিজ্ঞানীরা জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছেন মধ্যযুগে। আবুল হাসান বায়ুমণ্ডলসংক্রান্ত প্রতিফলন এবং আল মাইমুন গ্রহের তীর্যক গতি সম্পর্কে তথ্য উদঘাটন করেন। ইবনে জুনাস, নাসির উদ্দিন তুসি ও আল-বাণী-জ্যোতির্বিজ্ঞান-সম্পর্কিত নির্ঘণ্ট প্রণয়ন করেন। ইউরোপে মানমন্দির প্রতিষ্ঠার প্রথম কৃতিত্ব মুসলমানদের। মুসলমানরা ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকেও জ্ঞান আহরণ করেন এবং ভারতীয় গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন।
মধ্যযুগে গণিতশাস্ত্রে আরব মুসলমানদের অগ্রগতি ছিল বিস্ময়কর। মুসলমানরা ইউরোপকে শূন্যের ব্যবহার শিক্ষা দেন। যা তাঁরা অর্জন করেছিলেন ভারতীয়দের কাছ থেকে। অধ্যাপক আর্নল্ডের অভিমত, ‘তাঁরা (মুসলমানরা) প্রকৃতপক্ষে সমতল ক্ষেত্র ও গোলাকার ত্রিকোণমিতির প্রতিষ্ঠাতা। যা প্রকৃতপক্ষে গ্রিক পণ্ডিতদেরও জানা ছিল না।’
আল-খারাজমি ছিলেন তাঁর যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
রসায়নশাস্ত্র গড়ে উঠেছে আরব বিজ্ঞানী আলকেমির হাত ধরে। হ্যামবোল্ট বলেছেন, আধুনিক রসায়নশাস্ত্র মুসলমানদের উদ্ভাবন এবং এ বিষয়ে তাঁদের কৃতিত্ব অতুলনীয় রূপে বিবেচিত। জাবির ইবনে হাইয়ান, যিনি পশ্চিমা জগতে জেবের নামে পরিচিত তাঁকে আধুনিক রসায়নশাস্ত্রের জনক বলা হয়। রসায়নশাস্ত্রের ওপর তিনি ৫০০ গ্রন্থ রচনা করেন।
দর্শনশাস্ত্রে মুসলমানদের দান পৃথিবীর অন্য যে কোনো জাতির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। পিকে হিট্টির অভিমত, আরবদের কাছে দর্শনশাস্ত্র ছিল মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ছেড়ে নিরূপণসাপেক্ষ বস্তুর যথার্থ রূপ বিশ্লেষণের সত্যিকার জ্ঞান। আর আলফ্রেড গুইলিয়াম বলেন, আরবরা প্রাচ্য জ্ঞানের অগ্নিশিখা অনন্তকালের জন্য নির্বাপণকারী মোঙ্গলদের মতো বর্বর হলে ইউরোপের পুনর্জাগরণ আরও শতাধিক বছর বিলম্বিত হতো। আল ফারিবি ছিলেন মুসলিম জাহানের একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। ইমাম গাজ্জালীর পরিচিতি একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে।
ইতিহাস চর্চায়ও মধ্যযুগের মুসলমানরা উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর হাদিস সংকলনে যে নিষ্ঠার পরিচয় দেওয়া হয়েছে তার কোনো তুলনা নেই। আল বালাজুরি, আল ওয়াকিদি আল ইয়াকুবি ইতিহাস চর্চায় অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। আল তাবারি ছিলেন মুসলিম ইতিহাসের জনক। তাঁকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, মুসলমানরা তাদের পথ চলার এই গাইড লাইনকে হেলায় হারিয়ে ফেলে ৭০০ বছরের মধ্যেই। মিসরীয় ইতিহাসবিদ ড. রাগিব সারজানি তাঁর ‘উসমানী সালতানাতের ইতিহাস’ বইতে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। এতে বলা হয়, পঞ্চদশ শতাব্দী ছিল ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের জাগরণের শতক। এ শতাব্দীতে প্রথমে ইতালি ও ফ্রান্স পরে ইংল্যান্ড ও পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব সংগঠিত হয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুরু হয় জাগরণ। ইউরোপের এ জাগরণের প্রচার-প্রসারে মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার সদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। এই একটি মাত্র আবিষ্কার ইউরোপীয় বিভিন্ন রাষ্ট্রকে বাদবাকি বিশ্ব থেকে বহু দূর এগিয়ে দেন।
১৪৫০ খ্রিস্টাব্দেও দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ইউরোপের সব বইপত্র ছিল হস্তলিখিত। জার্মান প্রকৌশলী ইয়োহানেস গুটেনবার্গ পঞ্চদশ শতকের চল্লিশের দশকে জার্মানির মাইনৎস নগরীতে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বোদ্ধাজনদের মতে, গুটেনবার্গের এই আবিষ্কার ছিল মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। যা জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ১৪৮০ সালে ইউরোপের শতাধিক নগরীতে ছাপাখানা তৈরি হয়। ফলে পঞ্চদশ শতকের বাকি সময় ইউরোপে ছাপা হয় প্রায় ১ কোটি কপি বই। ষোড়শ শতকে ইউরোপে মুদ্রিত বইয়ের সংখ্যা ছিল ২০ কোটিরও ওপরে।
সপ্তদশ শতকে এই সংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়ে যায়! ইউরোপ যখন এই ৪০ কোটি বই অধ্যয়ন করছিল, জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা যখন সমৃদ্ধ হচ্ছিল তখন মুসলিম বিশ্বের অবস্থা কী ছিল? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ইউরোপ যখন মুদ্রিত বইয়ের কল্যাণে অভূতপূর্ব বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন তুরস্কের অটোমান সুলতান কাঠমোল্লাদের দেওয়া এক অদ্ভুত ফতোয়ায় সায় দেন। যে ফতোয়ার মাধ্যমে সারা দুনিয়ার মুসলিম জাতির সামনে এগিয়ে চলার বদলে কল্পকথার ভূতের মতো পেছন পানে হাঁটার আত্মঘাতী ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়।
অটোমান সম্রাটের পোষ্য গ্র্যান্ড মুফতির ফতোয়ায় সাম্রাজ্যে মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মোল্লারা তাদের জারি করা ফতোয়ার পেছনে যুক্তি দেখান, মুদ্রণযন্ত্রের মাধ্যমে পবিত্র কোরআন ও ধর্মীয় গ্রন্থসমূহের বিকৃতি সাধনের আশঙ্কায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই ফতোয়ার ভিত্তিতে সুলতান দ্বিতীয় বায়জিদ ১৪৮৫ সালে তার সাম্রাজ্যে মুদ্রণযন্ত্রের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করেন।
ওই ফতোয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ হলেও অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসরত ইহুদিরা নিজেদের ধর্মীয় গ্রন্থ সংরক্ষণে মহামহিম মুদ্রণযন্ত্র আমদানির অনুমতি প্রার্থনা করলে সম্রাট দ্বিতীয় বায়জিদ সম্মতি জানান। ১৪৯৪ সালে তুরস্কের অটোমান সম্রাট ইহুদিদের শর্তাধীনে মুদ্রণযন্ত্র আমদানির অনুমতি দেন। বলা হয়, আমদানি করা মুদ্রণযন্ত্র দিয়ে আরবি বা তুর্কি ভাষার কোনো বই ছাপা যাবে না, কেবল ইহুদিদের হিবরু ভাষার বইপত্র ছাপানোর অনুমতি থাকবে। সপ্তদশ শতকের ১৬১০ সালে লেবাননের খ্রিস্টান আরবদেরও ছাপাখানা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। ছাপাখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয় কোজহায়া আশ্রমে। ১৬২৭ সালে গ্রিক অর্থোডক্সদের জন্য ছাপাখানা চালু হয়।
পরবর্তী প্রায় তিন শতাব্দী অটোমান খলিফারা দ্বিতীয় বায়জিদের নীতিতে অবিচল থাকেন। তাঁর পুত্র প্রথম সেলিম আব্বাসীয় খেলাফতের পতন ঘটিয়ে নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন। অটোমান খিলাফতের অধীনে প্রায় ৩০০ বছর ধরে মুদ্রণযন্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। অটোমান সাম্রাজ্যের বাইরেও মুসলমানরা ফতোয়ার কারণে মুদ্রণযন্ত্র থেকে দূরে থাকাকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে ভাবে। অবশেষে ১৭১৬ সালে তৎকালীন শাইখুল ইসলাম আবদুল্লাহ আফেন্দি মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহারের বৈধতা দিয়ে ফতোয়া জারি করেন। ১৭২৭ সালে অটোমান খিলাফতের মুসলমানদের জন্য বা সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। অটোমান খিলাফতের অন্যান্য অংশে মুদ্রণযন্ত্র চালু হতে আরও প্রায় শত বছর কেটে যায়। যেমন মিসরের রাজধানী কায়রো মুদ্রণযন্ত্রের প্রথম সাক্ষাৎ লাভ করে ১৮২২ সালে। কায়রোর বুলাক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। অবশ্য এই কৃতিত্ব ইস্তাম্বুলের মহামহিম খলিফার নয়। মিসরে মুদ্রণযন্ত্র এনেছিলেন মুহাম্মাদ আলি পাশা। যিনি ছিলেন মিসরে অটোমান খলিফার গভর্নর। যার মাধ্যমেই মিসরে মুদ্রণযন্ত্র আসুক না কেন এজন্য সময় রেখেছে ৪০০ বছর। মিসর ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলোর একটি। এশিয়া-আফ্রিকার অন্যান্য প্রদেশে বিজ্ঞানের এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার পৌঁছাতে যে আরও বেশি দিন সময় লেগেছে তা সহজেই অনুমেয়। জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে থাকা মুসলমানদের অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছ থেকে ৫০০ বছর পিছিয়ে রাখে অটোমান সাম্রাজ্যের গ্র্যান্ড মুফতির একটি বিতর্কিত ফতোয়া। ৩০০ বছর পর মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহারে বৈধতা দেওয়া হলেও তা কার্যকর হতে যে সময় লেগেছে তা-ও ক্ষমাহীন অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। এ মুহূর্তে পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রতি চারজনের একজন মুসলমান। যাদের সংখ্যা ২০৫ কোটিরও বেশি। ইহুদিদের সংখ্যা মাত্র দেড় কোটি। অর্থাৎ ইহুদিদের চেয়ে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১৪০ গুণ বেশি। কিন্তু জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের অবদান ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী ইহুদিদের কত শতাংশ তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে।
মধ্যযুগে যারা বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ মুদ্রণযন্ত্র থেকে দূরে থাকা। এর ফলে ইউরোপজুড়ে জ্ঞানবিজ্ঞানের ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও মুসলমানরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমনকি তুরস্কের অটোমান খেলাফতের অধীনে যেসব ইউরোপীয় দেশ ছিল, সেগুলোর বিকাশও রুদ্ধ হয়েছে প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকার কারণে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পিছিয়ে বলেই ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে আরবদের ওপর ছড়ি ঘোরানো সম্ভব হচ্ছে। এ দুরবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ জ্ঞানবিজ্ঞানে আরও মনোযোগ দেওয়া। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে হাজার হাজার কোটি ডলার দামের বিমান উপহার দিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে পরিচয় দিয়ে বাহাবা পেলেও জ্ঞানবিজ্ঞানের পেছনে ধনাঢ্য আরব দেশগুলোর বিনিয়োগ আহামরি কিছু নয়। এই মানসিকতার কারণেই মুসলমানরা আজ পশ্চিমা শক্তির মানসিক দাসে পরিণত হচ্ছে। এ লজ্জার অবসানে জ্ঞানবিজ্ঞানের পথে ফিরে যাওয়ার বিকল্প নেই।
লেখক : সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন