স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সাংসদ জাফর আলমের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ কক্সবাজার-১ আসনের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে তার জুলুম অত্যাচারে এলাকার মানুষ মুখ না খুললেও এখন খুলতে শুরু করেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলমের বিরুদ্ধে সরকারি বনভূমি দখল, জমি দখল, চিংড়ি ঘের দখলের অনেক অভিযোগ রয়েছে।
এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে আলোচনায় এসেছে চিংড়িঘের দখল, গরু চুরি, সাধারণ মানুষের জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ। তার এসব কারণে সরকার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়নি। এবার তাকে প্রতিহত করতে এ দুই উপজেলার মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, জাফর আলমের দুর্নীতির কারণে এবার বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক নির্বাচনি দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন।
জানা যায়, কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জাফর আলম। এমপি হওয়ার পর গত পাঁচ বছরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তার সম্পদ। বেড়েছে স্ত্রী ও পুত্রের সম্পদও। চকরিয়া-পেকুয়ায় তার কথাই যেন আইন! রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। পাহাড় কাটা, নদী দখল ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ওই বাহিনীকে কাজে লাগান তিনি। গত বছরের ১৫ আগস্ট অস্ত্রধারীর পাশে দাঁড়িয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলম। স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে কেনা জমি দখল নিতে সোহেল নামে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হন।
এ পর্যন্ত জাফর আলমের নেতৃত্বে মিছিল থেকে তার বাহিনী গুলি চালিয়ে প্রতিপক্ষের অন্তত ৫ জন রাজনীতিক কর্মীকে হত্যা করেছে। তার ভাতিজা জিয়াবুল হক ও ভাগিনা মিজানুর রহমান গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্বে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছেন।
জাফর আলম গত ১৯ ডিসেম্বর পেকুয়ার একটি নির্বাচনি সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে সমালোচনায় তার চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতিও পান। ২০১৮ সালে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। অল্প সময়ে মালিক হয়েছেন বিপুল অর্থ সম্পদের। এমপি হওয়ার পাঁচ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে দশ গুণ। তার স্ত্রী শাহেদা বেগম স্কুল শিক্ষিকা। স্বামী এমপি হওয়ার পর ফুলে ফেঁপে উঠেছে তার সম্পদও। এবারের নির্বাচনি হলফনামায় তার সম্পদের পরিমাণ উঠে এসেছে।
অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি জাফর আলম ও তার পরিবারের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর অংশ হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুদকের কক্সবাজার কার্যালয়ে জাফর আলম, তার স্ত্রী শাহেদা বেগম, ছেলে তানভির সিদ্দিকী তুহিন ও মেয়ে তানিয়া আফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দুদকের একটি সূত্র বলছে, জাফর আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সরকারি জমি ও জলমহাল দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং অবৈধভাবে বালু বিক্রি করে ২৩টি দলিলে ২৪ একর জমি নামে-বেনামে কিনে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া চকরিয়া ও পেকুয়ায় তিনটি মার্কেট রয়েছে তার, গাড়ি রয়েছে কয়েকটি। সব মিলিয়ে প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি।
দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি জাফর আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় তার বার্ষিক আয়, অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদ ছিল ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার ৯৯৩ টাকা। যেখানে তার নিজের নামে ছিল ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৩ টাকার সম্পদ আর স্ত্রীর নামে ছিল ৬২ হাজার ৪০ টাকার ৫০০ টাকার সম্পদ। যৌথ মালিকানা বা তার আয়ের ওপর নির্ভরশীলদের কোনো আয় ছিল না।
২০২৩ সালে এসে তার বার্ষিক আয়, অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৫ টাকা। যেখানে রয়েছে তার নিজের নামে ১০ কোটি ৭৮ লাখ ৬৩ হাজার ৮৯ টাকার সম্পদ। তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ২ কোটি ২১ লাখ ৭১ হাজার ২৫৪ টাকা, যৌথ মালিকানায় রয়েছে ৩ কোটি ২৩ লাখ ৯০ হাজার ৩৫৭ টাকা এবং তার আয়ের ওপর নির্ভরশীলদের রয়েছে ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৬০৩ টাকার সম্পদ।
হলফনামার তথ্য বলছে, এমপি জাফর আলমের পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৭ গুণ।
এমপি জাফর আলম পেকুয়ায় সরকারি জলাশয় ও ড্রেন ভরাট করে তার মেয়ে তানিয়া আফরিন ও মেয়ের স্বামীর নামে নিউমার্কেট নির্মাণ করেছেন। যার বাজার মূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। এই মার্কেট নির্মাণে সদর ইউনিয়নের বাইম্যাখালীর মো. আলমগীরের এক একর জায়গা দখলের অভিযোগ রয়েছে এই সাংসদের বিরুদ্ধে।
মো. আলমগীর বলেন, ‘২০১৫ সালে জায়গাটি ক্রয় করি। পাঁচ বছর আমার ভোগদখলে ছিল। জাফর আলম এমপি হওয়ার পর ২০২০ সালে আমার সেই জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ শুরু করেন। তার ক্যাডার বাহিনীর কাছে তখন অসহায় ছিলাম। পরে এ ব্যাপারে আদালতে মামলা করি।’
এই মার্কেট নির্মাণে পেকুয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন ৬০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫ মিটার প্রস্থের রাস্তাটিও দখল করার অভিযোগ উঠেছে এমপির বিরুদ্ধে। এতে ১২-১৫টি পরিবার অবরূদ্ধ হয়ে পড়েছে।
অন্যের জমি দখল করে চকরিয়া পৌরসভা ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছেলে তুহিন ও মেয়ে তানিয়ার নামে আরেকটি মার্কেট নির্মাণ করছেন এমপি জাফর আলম, যার বাজারমূল্য দুই কোটি টাকা। তিনি পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে তানিয়া আফরিনের নামে দুই একর জমি কিনে তা ভরাট করে দখলে নিয়েছেন। এটির মূল্য দুই কোটি টাকার বেশি। তানিয়া আফরিন ও তুহিনের নামে পৌরসভার চিরিংগার বিভিন্ন স্থানে জায়গা কিনেছেন। এসব জমি অনেকটা জমির মালিককে বিপদে ফেলে কিনে থাকেন। সিস্টেমপ্লাজা নামে আরেকটি মার্কেট রয়েছে তার, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে রয়েছে শপিংমল শাহেদা কমপ্লেক্স। এছাড়া ছেলে তুহিনের নামে তিনি তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন বলে জানান স্থানীয়রা।
এমপি জাফরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হলো- তিনি চকরিয়া বাস টার্মিনালের পূর্ব পাশে জলাশয় দখল ও ভরাট করে কয়েকজনের কাছে বিক্রি করেছেন। রামপুর মৌজায় গ্রামীণ ব্যাংকের নামে বরাদ্দ ৩০০ একরের চিংড়ি প্রজেক্ট এক চেয়ারম্যানকে দিয়ে রাতারাতি দখল করে নিয়েছেন। বরইতলী-মগনামা সড়কে নবনির্মিত বানৌজা শেখ হাসিনা ঘাঁটি সড়কে মাটি দেওয়ার নাম করে মছনিয়া কাটা এলাকায় সাবাড় করেছেন বিশাল পাহাড়।
অভিযোগ রয়েছে, মতের অমিল হলে দলের লোককেও ছাড় দেন না সংসদ সদস্য জাফর আলম। তার কারণে চকরিয়া-পেকুয়ায় আওয়ামী লীগে বিভক্তি। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোটে জয়ী হলেও এখন দলের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না তিনি।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এস এম গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘গেল ইউপি নির্বাচনে এমপি জাফরের কারণেই নৌকার অধিকাংশ প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। চকরিয়া-পেকুয়ার আওয়ামী লীগে বিভক্তি হয়েছে তার কারণে।’
চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপিত ফজলুল করিম সাঈদীর অভিযোগ, ‘চকরিয়া-পেকুয়ার আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীকে বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন এমপি জাফর আলম। তাদের দিয়ে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করছেন না।’
ফজলুল করিম সাঈদী আরও বলেন, ‘এমপি তার বাহিনী দিয়ে শতকোটি টাকার জমি দখল করেছেন। প্যারাবন কেটে দখল করেছেন প্রায় দুই হাজার একর চিংড়ি চাষের জমি। নদীতে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন।’
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমেদ সিআইপি বলেন, ‘জাফর আলম এমপি হওয়ার পর চকরিয়া-পেকুয়ার সন্ত্রাসী-অস্ত্রধারী ও ডাকাতদের নিয়ে ‘জাফর লীগ’ গঠন করেছেন। জায়গা দখল, পাহাড় কাটা ও নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে তার বাহিনী। এমন কোনো অপরাধ নেই যেটি তার বাহিনী করছে না। ভয়ে কেউ মুখও খুলতে পারছেন না।’