২৬ মে, ২০২৪ ১৬:৫৩

৪১ হাজার ফুট উঁচুতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন আশিক

অনলাইন ডেস্ক

৪১ হাজার ফুট উঁচুতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন আশিক

বিশ্ব রেকর্ড গড়তে ৪১ হাজার ফুট উঁচু থেকে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মাঝ আকাশে লাফ দিলেন বাংলাদেশি স্কাইডাইভার আশিক চৌধুরী। শনিবার ২৫ মে বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটার পরে যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসের উইংস ফিল্ড বিমানঘাঁটি থেকে বিমানে উড়ে এ প্রচেষ্টা চালান আশিক। আর এর মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ সময় ধরে পতাকা হাতে শূন্যে ভেসে বেড়ানো এবং মাটিতে নেমে আসার বিরল রেকর্ডটি নিজের করতে যাচ্ছেন আশিক চৌধুরী। তবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসার আগেই গর্বিত করলেন দেশকে। এর আগে আর কো বাংলাদেশি স্কাইডাইভার এতো উঁচু থেকে পতাকা হাতে লাফিলে পড়ার চেষ্টা করেননি।

ঠিক এক সপ্তাহ আগে গণমাধ্যমকে পুরো পরিকল্পনাটি জানিয়েছিলেন আশিক। বলেছিলেন, যদি আবহাওয়া ঠিক থাকে তাহলে ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মেনফিস্ট শহরের টেনেসি স্টেটে স্কাইডাইভিং করবেন আশিক। আবহাওয়া ঠিকঠাক মতো থাকায় কাজটি করেই ফেললেন আশিক। সাধারণত স্কাইডাইভাররা মাটি থেকে ১২ হাজার বা ১৩ হাজার ফুট থেকেই আকাশে লাফ দেন। ১৫ হাজার ফুট উপরে গেলে নিতে হয় বাড়তি অক্সিজেন। যেহেতু স্ট্যাটোসফিয়ার শুরু হয় ৩৬ হাজার ফিট থেকে। কাজেই এর উপরে গেলে সেখানে বাতাস থাকবে না। আশিক লাফ দিয়েছেন ৪১ হাজার ফুট থেকে, মানে স্ট্যাটোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে আর পাঁচ হাজার ফুট উপর থেকে। এই উচ্চতায় আবার তাপমাত্রা মাইনাস ৬৫ ডিগ্রি। তারমানে ফুল থার্মাল বডিকিট পড়েই তাকে নামতে হয়েছে আকাশে। অনেকটা স্পেস স্যুটের মতন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আশিককে বহনকারী বিমানটি ৪১ হাজার ফিট উচ্চতায় উঠে যায়। এই উচ্চতা থেকে আশিক যখন মেঘের রাজ্যে লাফ দেন, তখন পৃথিবী যে গোলাকার সেটা খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। হাতে পতাকা নিয়ে ক্রমাগত মেঘ ভেদ করে মেনফিস্টের আকাশে আশিক উড়ছিলেন পাখির মতন। মাটি থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট কাছাকাছি সময়ে পিঠের প্যারাস্যুটটা খুলে দেন তিনি। ধীরে ধীরে নিরাপদে নেমে আসেন মাটিতে। সেই সঙ্গে সাফলতার সঙ্গে শেষ করেন স্বপ্নের স্কাইডাইভিং মিশন। মেনফিস্টের আকাশে আশিকের স্কাইডাইভিংয়ের নাম দেয়া হয়েছিল ‘দ্য লারজেস্ট ফ্ল্যাগ ফ্লোন স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার’। তার পুরো স্কাইডাইভটি বিশ্লেষণ করছে গিনেজবুক কর্তৃপক্ষ। এখন অপেক্ষা তাদের স্বীকৃতির। আর সেটি হলে চারটি রেকর্ড ভেঙে নিজের নাম নতুন করে লেখাবেন বাংলাদেশের আশিক।

চাঁদপুরে বাড়ি হলেও বাবার চাকরির সুবাদে আশিকের বেড়ে ওঠা যশোরে। স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়েছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। ২০০৭ সালে স্নাতক হয়েই যোগ দেন দেশের বেসরকারি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। ছুটিছাটায় ছুটে যেতেন রোমাঞ্চের টানে। ২০১১ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানেই চাকরি করেছেন। তারপর পড়তে যান বিলেতে। সেখানেই যেন তাঁর স্বপ্নেরা ডানা মেলে। ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। আশিক চৌধুরীর স্বপ্নপূরণের দিন। যুক্তরাজ্যের ব্র্যাকলি শহরের হিনটন স্কাইডাইভিং সেন্টারে হাজির তিনি। জাম্পস্যুট, হেলমেট, প্যারাস্যুট, গগলসসহ যাবতীয় সুরক্ষাসামগ্রী পরে উঠে পড়লেন প্লেনে। সঙ্গে দুজন প্রশিক্ষিত স্কাইডাইভার। কয়েক হাজার ফুট ওপরে ওঠার পর একজন স্কাইডাইভার আশিককে সঙ্গে নিয়ে বিমান থেকে লাফ দেন। আকাশে উড়তে উড়তে আশিকের মনে হলো— পাখির জীবনটা কতই না সুন্দর! স্কাইডাইভারের স্বীকৃতি পাবার জন্য লাইসেন্স প্রয়োজন । আর সেটা পাবার জন্য পাড়ি দিতে হয় লম্বা পথ। থিওরি জানা, বই পড়া, লিখিত পরীক্ষা দেয়া এবং ন্যূনতম ২৫ বার বড় কোনো উচ্চতা থেকে সফলতার সাথে স্কাইডাইভিংয়ের অভিজ্ঞতা থাকা। আশিক সবগুলো ধাপ পেরিয়েই লাইসেন্স হাতে পেয়েছেন।

স্কাইডাইভার আশিক চৌধুরী বলেন, লন্ডন বিজনেস স্কুল থেকে মাস্টার্স শেষ করে আমেরিকান এয়ারলাইন্স লন্ডন অফিসে যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত কিছুটা সময় বিরতি নিলেও, স্কাইডাইভারের সাহায্য ছাড়া লাফ দেয়ার ইচ্ছা কখনই ছেড়ে দেইনি। আকাশে পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর রোমাঞ্চ সব সময়ই তাড়া দিতো। বাবা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর হারুন চৌধুরীর কথা মনে পড়ে। পাইলট বাবার কাছে আকাশে ওড়ার কত গল্পই না শুনেছেন। গল্প আর বাস্তবতার ফারাকটা ঘুচিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে আশিকের। ২০১৪ সালে ভর্তি হন একটি প্রাইভেট পাইলট প্রশিক্ষণ স্কুলে। এক বছর ধরে চলে প্রশিক্ষণ। এরপর একদিন ককপিটে বসেন আশিক। লন্ডন থেকে উড়োজাহাজ নিয়ে ছুটে যান পাশের এক শহরে। আশিক বলেন, এরপর মাঝেমধ্যেই প্লেন ভাড়া করে পরিবার নিয়ে লন্ডন থেকে ম্যানচেস্টারে চলে যেতাম। লাঞ্চ করে আবার ফিরতাম লন্ডনে। সেই দেশে এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। পাইলট হলেও স্কাইডাইভিংয়ের পোকাটা আশিকের মাথায় থেকেই যায়। পেশাগত কাজের চাপে প্রশিক্ষণ আর নেয়া হয় না। সেই সুযোগ আসে গত বছর অক্টোবরে। সম্মানজনক চাকরি, পেশাগত জীবনে সাফল্যের হাতছানি সত্ত্বেও বিদেশের মাটিতে থিতু হবার ইচ্ছা বাদ দিয়ে ২০১৯ সালে দেশে ফেরেন আশিক।

আমেরিকান এয়ারলাইনসের এশিয়া ও ইউরোপ অঞ্চলের ফিন্যান্স বিভাগের প্রধানের পথ থাকা অবস্থাতেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে দেন বহুজাতিক হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন-এইচএসবিসি ব্যাংকে। ঢাকায় চার বছর দায়িত্ব পালন করে গত বছরের শুরুতে চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেখানে নতুন পেশাগত জীবন শুরু হলেও আশিকের মাসের বড় একটা সময় কাটে বাংলাদেশ ও ভারতে। এই শহরেই থাকে তাঁর পরিবার। সিঙ্গাপুরের অফিস শুরু করার পর আশিকের স্কাইডাইভিংয়ের স্বপ্নটা জ্বলে ওঠে। থাইল্যান্ডে স্কাইডাইভিংয়ের দারুণ সুযোগ আছে। সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ডে যাতায়াতও সহজ। যোগাযোগ করলেন থাই স্কাই অ্যাডভেঞ্চার কোম্পানি নামের এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। লিখিত পরীক্ষাসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে গত বছর হাজির হলেন অনুশীলনে। এক দশকের বেশি সময় পর, অবশেষে স্কাইডাইভিংয়ের উদ্দেশ্যে উঠে পড়লেন উড়োজাহাজে। একজন পেশাদার স্কাইডাইভার আশিককে নিয়ে লাফ দিলেন। সেই থেকে শুরু।

প্রশিক্ষণের দিনগুলোতে সপ্তাহান্তে সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ডে ছুটে যেতেন আশিক। দুই দিন অনুশীলন করে সিঙ্গাপুর ফিরে অফিস ধরতেন। দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণে কোনো প্রশিক্ষক আর আশিককে সঙ্গে নিয়ে লাফ দিলেন না। শুধু দুজন পেশাদার স্কাইডাইভার থাকলেন আশিকের দুই পাশে। আশিক নিজে নিজের প্যারাস্যুট খুলে নেমে এলেন মাটিতে। এভাবে ১০ বার লাফ দেওয়ার পর সহযোগিতার জন্যও কেউ সঙ্গে থাকল না। লাফ দিলেন একা। সেই লাফে সফলও হলেন আশিক। এভাবে চার সপ্তাহ পর ২৫তম বার লাফ দেন আশিক। এরপর আরও কয়েকবার লাফ দেওয়ার পর আশিকের হাতে তুলে দেওয়া হয় স্কাইডাইভারের লাইসেন্স। এই লাইসেন্স দেখিয়ে বিশ্বের যে কোনো দেশে স্কাইডাইভিং করতে পারবেন আশিক, যার শুরুটাই তিনি করে দেখালেন মেঘের রাজ্যে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে।  সূত্র : একাত্তর টিভি।

বিডি-প্রতিদিন/শআ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর