শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধা নিয়ে বিদেশ থেকে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য কাগজ আমদানিতে ফায়দা লুটছে একটি অসাধু চক্র। মুদ্রণ শিল্পের কাঁচামালের সুবিধা পাওয়া এই আমদানি পণ্য খোলাবাজারে বিক্রিতে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবুও বেশি মুনাফার আশায় খোলাবাজারে এই আমদানি করা কাগজ বিক্রি করে আসছে চক্রগুলো। এতে হুমকির মুখে পড়ছে দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব।
আমদানির সুযোগ নিয়ে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা বিদেশে চলে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে এসব তথ্য তুলে ধরে আমদানিতে শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করে বাংলাদেশ পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ)।
এর আগে, সংগঠনটির পক্ষে শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে দেওয়া আবেদনে বলা হয়, দেশি কাগজ কলগুলোর চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা কাগজ খোলাবাজারে বিক্রিতে বাংলাদেশের কাগজশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় ছাপার জন্য কাগজ আমদানিতে শুল্ক মওকুফের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে বিপিএমএ।
রাজস্ব সংস্থায় দেওয়া চিঠিতে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য শুল্কমুক্ত আমদানি করা ছাপার কাগজ বিশেষ বিবেচনায় আমদানির শর্ত ভঙ্গ করে খোলাবাজারে বিক্রি রোধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
একই সঙ্গে অবহিত করা হয়, ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি অসাধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী একজন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির পারস্পরিক যোগসাজশে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য শুল্কমুক্ত আমদানি করা ছাপার কাগজ উচ্চমূল্যে খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে। আমদানি করা সাত হাজার ৭৫০ টন ছাপার কাগজ মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ করার পরিবর্তে বেশি মুনাফা লাভের জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেছে ওই প্রতিষ্ঠান।
উল্লেখ্য, ওই প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র অনুযায়ী আমদানির পরিমাণ সাত হাজার ৭৫০ টন হলেও প্রকৃতপক্ষে আমদানির পরিমাণ আরো বেশি। একদিকে বিশেষ বিবেচনায় শুল্কমুক্ত আমদানির শর্ত ভঙ্গ করেছে এই অসাধু চক্র। অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করেছে।
এদিকে, দেশীয় মিলগুলোর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী, চাহিদার সব কাগজ সরবরাহে সক্ষমতা রয়েছে। এই অবস্থায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির সুযোগ নিয়ে এ ধরনের অপতৎপরতা চলছে, যা দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি স্বরূপ।
কাগজ উৎপাদন শিল্পের সংগঠনটি জানায়, দেশীয় শিল্প ধ্বংসের এই অশুভ চক্রান্তের পুনরাবৃত্তি এখনই শক্ত হাতে রোধ করা না গেলে আগামী দিনে অন্যরাও এই অনৈতিক কাজে উৎসাহিত হবে।
বিপিএমএর পক্ষ থেকে থেকে দাবি জানানো হয় যে, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি ওই কাগজ আমদানির জন্য প্রযোজ্য শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) মওকুফে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে তা জরিমানাসহ আদায়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এনবিআরের কাছে অভিযোগ জানানোর আগে শিক্ষা উপদেষ্টার কাছেও বিষয়টি জানিয়েছে এই শিল্প খাতের সংগঠনটি।
অন্য এক চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিপিএমএ জানায়, শুল্কমুক্ত ছাপার কাগজ আমদানির সুযোগ বন্ধ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে ছাপার কাগজের ওপর আমদানি পর্যায়ে প্রযোজ্য সিডি ও আরডি মওকুফ করায় দেশীয় কাগজশিল্প খাতের উদ্যোক্তারা উদ্বিগ্ন। তারা আশঙ্কা করছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পারস্পরিক যোগসাজশে বন্ড সুবিধার মতো আলোচ্য শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার অপব্যবহার করছে। বৈশ্বিক মন্দায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব বিলীন করার অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত হয়েছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় এরই মধ্যে আমদানি করা কাগজ খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে। বিশেষ মহলটি ভবিষ্যতেও শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করবে। এই অযৌক্তিক সুবিধা অব্যাহত থাকলে দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
সংগঠনটি জানায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাগজশিল্প আমদানি বিকল্প, রফতানিমুখী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশে নিবন্ধিত ১২৮টির মধ্যে স্থাপিত ১০৬টি পেপার মিলের বছরে ১৬ লাখ টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে নয় লাখ মেট্রিক টন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত কাগজ ৪০টিরও বেশি দেশে রফতানি করছে। এতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে ২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর পরোক্ষভাবে এক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। এই খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন দেশীয় কাগজশিল্পের উদ্যোক্তারা। কাগজশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে ৩০০টির বেশি সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে। এই খাত প্রতি বছর পাঁচ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব দিয়ে আসছে। আমদানি বিকল্প শিল্প হিসেবে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে।
সংগঠনটি আরও জানায়, দেশের কাগজশিল্পের যাত্রা অনেক দিনের হলেও বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের অসাধু কর্মকাণ্ডে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। বর্তমানে এই শিল্প এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও স্বার্থান্বেষী মহল পারস্পরিক যোগসাজশে বিদ্যমান উদার নীতির অপপ্রয়োগ তথা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার, মিথ্যা ঘোষণা ও চোরাচালানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কাগজ আমদানি করছে। এতে করে দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এরই মধ্যে ৮০টি কাগজ মিল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া, অবশিষ্ট ২৬টি মিল কোনো রকমে ধুঁকে ধুঁকে চলছে।
প্রসঙ্গত, এনসিটিবির চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন কাগজ সঠিক মূল্যে যথাসময়ে সরবরাহ নিশ্চিত করার সক্ষমতা বিপিএমএর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে। ২০ বছর ধরে এনসিটিবি সরাসরি কেনা কাগজ দেশীয় মিলগুলো নির্ধারিত গুণগতমান অনুযায়ী এবং এনসিটিবির সব শর্ত পরিপালন করে সরবরাহ করে আসছে। অথচ এনসিটিবির কার্যাদেশ পাওয়া মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় মিলের কাগজ না কিনে বিনাশুল্কে ছাপার কাগজ আমদানি করছে। এই ক্ষেত্রে এনবিআরের এই সিদ্ধান্ত দেশীয় কাগজশিল্পের জন্য আত্মঘাতী।
এছাড়া, দেশীয় মিলগুলোর উৎপাদিত কাগজ এনসিটিবিতে সরবরাহের জন্য ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। অথচ আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থানীয় ও আমদানি করা কাগজের মধ্যে তীব্র বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এ অবস্থায় দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা দেশীয় কাগজশিল্প খাত ও এর সঙ্গে নির্ভরশীল প্রায় ৩০০টি লিংকেজ শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা এবং এক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ সুরক্ষায় শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি উঠেছে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাগজ আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক ও ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক শর্তসাপেক্ষে মওকুফ করা হয়। কাগজ আমদানিতে শুল্ক মওকুফ সুবিধা নিলেও অনেকেই শর্ত মানছে না।
বিডি প্রতিদিন/কেএ