১৯ মে, ২০২০ ১০:১৮

একে ‌অন্যকে হারাতে গিয়ে দিনশেষে সবাই মিলে হারছেন!

বাণী ইয়াসমিন হাসি

একে ‌অন্যকে হারাতে গিয়ে দিনশেষে সবাই মিলে হারছেন!

বাণী ইয়াসমিন হাসি

আমি যখন ফোর্থ ইয়ারে ; জলিল ভাই তখন পার্টির সেক্রেটারি। উনি খুব কর্মীবান্ধব নেতা ছিলেন। মাঝে মাঝেই উনার বাসায় যেতাম। এমনই এক সকালের ঘটনা। উনার এলাকার দুই নেতা এসেছেন একজনকে সাথে করে নিয়ে। সে বিরাট মেধাবী, আমেরিকায় জামাইয়ের কাছে যাবে। জলিল ভাইয়ের কাছে তাদের আবদার ভাই যেন পার্টির প্যাডে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট/সেক্রেটারি কে লিখে দেন ঐ আপু কতটা নিবেদিত প্রাণ নেতা, তার কত অবদান এবং তাকে পূনর্বাসনের যাবতীয় ব্যবস্থা যেন উনারা গ্রহন করেন। ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মেয়েটাকে চেনো? ও কি তোমাদের সাথে ছাত্রলীগ করে? আমি বললাম উনাকে চিনি কিন্তু উনি তো আই হেট পলিটিক্সদের দলে(আপুটা প্রচন্ড স্বার্থপর, সারাদিন লাইট বন্ধ করা, কাপড় শুকানো এসব নিয়ে রুমমেটদের সাথে ঝগড়া করতো। ডাইনিং, কেন্টিন, দোকান, পেপার রুম, রিডিংরুম, টিভিরুম সর্বত্রই শুধু ঝগড়া করতো। আর আমরা যারা পলিটিক্স করতাম তাদের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাতো)। আমি উনাদের পেছনে ছিলাম। মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখেই সুড়সুড় করে কেটে পড়লো।

একটা নিউজ পোর্টালে কাজ করার সুবাদে অনেক হোমড়া চোমড়াদের সাথে প্রতিনিয়ত দেখা হয়, কথা হয়। অধিকাংশের মধ্যেই তীব্র ছাত্রলীগ বিদ্বেষ দেখতে পাই। অবশ্য এরা প্রায় প্রত্যেকেই বলে তারা ছাত্রলীগ করতো এবং অনেক হ্যাডমওয়ালা নেতা ছিল। জার্নালিজমে পড়ার সময় আমার শিক্ষকরা একটা জিনিস খুব ভালোভাবে মাথায় গেঁথে দিয়েছেন-সেটা হলো ক্রস চেক না করে কোন ইনফরমেশন কে ফাইনাল হিসেবে না ধরতে। তাই আমার মধ্যে ঝালিয়ে দেখার একটা ভীষণ কৌতুহল কাজ করে। আমি শুরুতেই খুব গদগদ হয়ে বলি তাই নাকি ভাই? বেশ বেশ। তা আপনার সময়ের অমুক ভাই তো আমার পরিচিত। আপনি কি উনার নেতা ছিলেন? উনি তখন চেয়ার দুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে যা বলেন- তার সারমর্ম হল, উনি অনেক ব্রাইট ছিলেন। উনার কি আর মিছিল মিটিং করার মত এত সময় ছিল। এসব তো সব ছোটলোক আর বাউন্ডুলেদের কাজ। আরো খোঁজ নিয়ে যেটা জেনেছি এদের চৌদ্দগোষ্ঠীতেও কেউ কখনো আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। কেউ কেউ আবার আমার কথার প্যাচে পড়ে শেষপর্যন্ত স্বীকার করেছেন- না সেইভাবে মিছিল মিটিং এ যাই নি কিন্তু মনে মনে সমর্থন করতাম।
আপনাদের চোখে যারা বাউন্ডুলে, চাষা, ছোটলোক তারাই কিন্তু একাত্তরে একটা পতাকার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন। আবার কোন সংকট আসলে আপনারা পালিয়ে বাঁচবেন। আর সামনে থেকে লড়াই করবেন তারা যাদেরকে আপনারা করুণার চোখে দেখেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ তম সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ অনেকটা খেদোক্তি করেই বলেন, ‘গরীবের বউ সবার ভাউজ (ভাবী)!! রাজনীতির অবস্থাটা ও আজ ভাউজের (ভাবীর) মত হয়ে গেছে।

এত বছর রাজনীতি করি কিন্তু আমি যদি আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এসব বিভাগে অধ্যাপক হতে চাই কিংবা হাসপাতালে যেয়ে ডাক্তারী করতে চাই করতে পারবো না, সবাই হাসাহাসি করবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা শেষ করে ৬৫ বছর বয়সে অনেকে রাজনীতিতে আসতে চান, সরকারি আমলারাও চান, সেনাবাহিনীর অফিসাররাও চান, চিকিৎসকরাও চান, প্রকৌশলীরাও চান, এমনকি পুলিশেরও অনেক ডিআইজি, আইজি'রা ও চান!

বিষয়টা সকল রাজনৈতিক দলগুলোর ভেবে দেখা উচিত। যদি কোন ক্ষেত্রে স্পেশালিষ্ট প্রয়োজন হয় তখন তাদের উপদেষ্টা হিসাবে রাখা যেতে পারে। রাজনীতিতে আসতে চাইলে পাশ করার পর চাকরি না করে রাজনীতিতে চলে আসবেন। হুট করে রাজনীতিবিদ হওয়া ঠিক না।’

করোনা মোকাবেলায় সরকার যে আমলানির্ভর হয়ে পড়ছে, তা এখন স্পষ্টই দৃশ্যমান। এর আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় পবিত্র রমজান উপলক্ষে রেস্টুরেন্ট খুলে দেয়ার অনুমতি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সময়ের একটি উক্তিতে। গণমাধ্যম কর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি রেস্টুরেন্টে ইফতার বিক্রির সিদ্ধান্তের বিষয়ে এখনো কিছু জানি না। আমি একটু জেনে নিই। সচিব বা ডিজির সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা, তা জেনে নিই।’ তার এই কথা শুনে মনে না করার কোন কারণ নেই যে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে এখন জনপ্রতিনিধিদের কোন হাত নেই। করোনা নিয়ন্ত্রণের সব ভার যেন আমলাদের কাঁধেই ভর করেছে। তারা মন্ত্রীকে জানাবেন কিনা, সেটি তাদের এখতিয়ার! অন্যথায় মন্ত্রী মহোদয় নিজেই তাদের কাছ থেকে জেনে নেবেন।

আমলা, বুদ্ধিজীবী, সুশীল, খেলোয়াড়, শিল্পী, অন্য পেশাজীবী এরা তো সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। একজন ভিসি, আইজিপি, বাহিনীপ্রধান, সচিব উনারা তো উনাদের কাজের সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেনই তারপরও কেন আবার তাদেরকেই প্রমোট করা?

জাতীয় দলের খেলোয়াড়, অভিনেতা/অভিনেত্রী, গায়ক/গায়িকা। এরা নানা ভাবে প্রমোটেড। আমি বিশ্বাস করি শেখ হাসিনা কর্মীদের মনের কথা বোঝেন। একজন নেতা ২০/২৫ বছর ধরে রাজনীতি করার পর সে মনোনয়নের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু দিনশেষে যখন মনোনয়ন পায় কোন সাবেক আমলা, খেলোয়াড় বা অভিনেত্রী তখন কিন্তু কর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে যায়।
অতীত অভিজ্ঞতা বলে আপনার দয়ায় পাওয়া টিকিটের তারা চরম অপব্যবহার করে। প্রথমেই তারা আপনার আওয়ামী লীগটাকে ভেঙে কয়েক খন্ড করে। তারপর আপনার দুর্দিনের কর্মীদেরকে সাইজ করে। এরপর তারা আওয়ামী বিরোধী আর সুশীলদের কে নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করে।
হ্যাঁ, উনারা হয়তো অনেক মেধাবী। উনাদের মেধাকে অন্য কোন কাজে লাগান। কিন্তু রাজনীতি টা রাজনীতিবিদদের দিয়েই করান প্লিজ।

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আস্তে আস্তে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে হারিয়ে ফেলছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘সরকারী কর্মচারীদের বলি, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনী নয়। পাকিস্তানের কলোনী নয়। যে লোককে দেখবে, তার চেহারাটা তোমার বাবার মত, তোমার ভাইয়ের মত। ওরই পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও। ওরাই সম্মান বেশী পাবে। কারণ, ওরা নিজেরা কামাই করে খায়।’

‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।"

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় যারা দেশের প্রকৃত মালিক তারাই আজ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। আমলাতন্ত্রের ফাঁকা আস্ফালনে সর্বত্রই নাভিশ্বাস উঠছে।জনমনে স্বস্তি নেই।

দলীয় নেতাকর্মীরা একে অন্যের কাপড় খোলার নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে। ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি। খুউব সুপরিকল্পিতভাবে সবগুলো উইং কে দুর্বল বা ধ্বংস করা হচ্ছে। কালিমালেপন করা হচ্ছে। শুরুটা ছাত্রলীগ দিয়ে তারপর যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মূল দলের সম্মেলনে বিতর্কিতদের প্রমোশন অথবা পূনর্বাসন, যুবমহিলা লীগ। এরপর কে বা কোন উইং?
কাঁদা ছোড়াছুড়ি না করে একটু ভাবুন। কিসের মোহে ছুটছেন? কাকে ধরতে দৌড়াচ্ছেন? নাকি কেউ আড়াল থেকে আপনাদের একজনের পেছনে অন্যকে লেলিয়ে দিচ্ছে? ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হচ্ছেন। একে অন্যকে হারাতে গিয়ে দিনশেষে সবাই মিলে হারছেন!

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর