১৯ মে, ২০২০ ১১:৫০

ভারতীয় সেনাবাহিনী সত্যিই কি আসছে বাংলাদেশে!

হাসান ইবনে হামিদ

ভারতীয় সেনাবাহিনী সত্যিই কি আসছে বাংলাদেশে!

প্রতীকী ছবি

যে শহর কোনদিন ঘুমায় না সেই শহর ঘুমিয়ে আছে - কবে এই ঘুম ভাঙবে কেউ জানে না। চারিদিকে স্তব্ধ। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। কোনো মানুষ দেখা যায় না কোথাও। শুধু থেকে থেকে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ। করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে নেমে এসেছে দুর্বিষহ আকারে। চলমান এ সমস্যা একদিন বা দু’দিনের সময় বেঁধে আসেনি, পাকাপোক্তভাবে বসেছে পৃথিবীর ওপর। কেউ জানে না কতদিন চলবে! এর প্রকোপে শুধু প্রাণহানিই হচ্ছে না, হচ্ছে মানহানি; আসছে দুর্ভিক্ষ মহামারী। মনে হয় কোনো উত্তরাধুনিক এক চলচ্চিত্রে পুরো পৃথিবী, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ অভিনয় করছে - কিন্তু কেউ জানে না এই চলচ্চিত্রের শেষ কোথায়। ঠিক ক'দিন আগেও যে নিউ ইয়র্ক শহর সরগরম ছিল, ঠিক ক'দিন আগেও যে শহর ছিল আলো ঝলমল, আজ সেই শহর স্তব্ধ, অন্ধকার। পুরো নগরী যেন এখন মৃত্যুপুরী। 

স্পেন, ইতালি, ইংল্যান্ডের নাগরিকরা বুঝি আজ মৃত্যুক্ষণ গুণছে। মহামারী আকারে করোনাভাইরাসের আবির্ভাবে নানা অমানবিক ঘটনা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। কেউ একসঙ্গে থাকতে পারছে না, বাইরে যেতে পারছে না, কাজ করতে পারছে না; এমনকি দৈনন্দিন জীবনের যা প্রয়োজন, তাও মিটাতে পাচ্ছে না। কেউ কাউকে সাহায্য সহযোগিতা করবে সেই অবস্থাও বুঝি নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সম্প্রীতি, ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি সব বুঝি পালিয়েছে। কিন্তু এতোসব বিপর্যয়ের মাঝেও এক দেশ অন্যদেশের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনার বিপর্যস্ত সময়ে আরেকবার বাংলাদেশের কাঁধে বন্ধুত্বের হাত রেখেছে ভারত। কিন্তু সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সহায়তাকেই ভুলভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে একদল ব্যস্ত ভারতবিরোধী অপপ্রচারে! বাংলাদেশে নাকি আসছে ভারতীয় সেনাবাহিনী! এমনি এক সংবাদ ছড়িয়ে দিয়ে করোনা পরিস্থিতিতে ভারতের দেয়া সহায়তাকে ভিন্নভাবে প্রচারে লিপ্ত তারা।  উদ্দেশ্য সেই একটাই, বহু পুরোনো ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট জাগ্রত করা। অবশ্য এবারের অপপ্রচারের সূত্রপাত একটি স্বনামধন্য ইংরেজি দৈনিক থেকে! তাহলে আসুন দেখে নেয়া  যাক করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পাশে কিভাবে দাঁড়িয়েছে ভারত আর প্রচার কিভাবে হচ্ছে!  

ঘটনা-১ঃ ফেব্রুয়ারি মাস, করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান শহর যেনো এক মৃত্যুপুরী। পুরো উহান শহর লকডাউনে, ঘরের ভেতর বন্দী অবস্থায় বুঝি তখন তারা মৃত্যুক্ষণ গুণছে। এমতাবস্থায় খবর আসে যে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আটকে পড়েছেন উহানে। সোশাল মিডিয়ায় তাদের দেশে ফিরে আসার আকুতি অনেকের চোখ তখন ভিজিয়ে দিয়েছিলো। বাংলাদেশ সরকার দ্রুততার সাথেই উহান থেকে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তখনো কিছু শিক্ষার্থী উহানেই রয়ে যায় যার খবর প্রচারিত হয় পরে৷ 

এদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ফ্লাইট আবার উহানে পাঠানোও হয়ে পড়ে জটিল ও কষ্টসাধ্য। ঠিক সেই মুহুর্তে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত। চীনের উহান শহরে আটকে পড়া ২৩ জন বাংলাদেশি নাগরিককে উদ্ধার করে দিল্লিতে ফিরিয়ে আনে ভারত সরকার। ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়। শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে কেউ ভাইরাস বহন করছে কিনা সেটাও নির্ণয় করে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দিল্লি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রেখে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় তাদের। বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনায় ভারতীয় বিমান বাহিনীকে ধন্যবাদ জানায় ঢাকা। 

ঘটনা-২ঃ আমরা সবাই জানি, এখন পর্যন্ত প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তবে এ নিয়ে রাতদিন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। সাফল্যের দেখা এখনও মেলেনি। কতদিন নাগাদ এই ওষুধ পাওয়া যাবে, তা-ও বলতে পারছেন না গবেষকরা। এমনি এক দুঃসময়ে আবারো বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ভারত। করোনা চিকিৎসায় বাংলাদেশকে ২০ লাখ ‘হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনন' দিচ্ছে ভারত সরকার। আমরা সবাই জানি, এখন পর্যন্ত প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তবে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ম্যালেরিয়ানিরোধী হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ ব্যবহারে ইতিবাচক ফল পাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে করোনা রোগীদের ওপর ম্যালেরিয়ানিরোধী এই ওষুধের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। 

যেখানে দেখা যায়,‘হাইড্রোকুইনন’ নামে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষ কার্যকর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য প্রতিষেধক হিসাবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন শনাক্ত করেছে। আর হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ওষুধের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ বর্তমানে ভারত। বিশ্বে এই মেডিসিনের মোট উৎপাদনের ৭০ শতাংশই ভারতে হয়। ইতোমধ্যেই এই ওষুধের জন্য ৩০টির বেশি দেশ ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এরপরেই বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের তালিকা তৈরি করেছে ভারত। প্রথম দফায় এসব দেশকে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। করোনার এই দুঃসময়ে বাংলাদেশকে এই বিপুল পরিমাণ ট্যাবলেট দেওয়া নিঃসন্দেহে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে। 

ঘটনা-৩ঃ
দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে ভারত। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাহায্য করার জন্য করোনাভাইরাস টেস্ট সেন্টার তৈরি ও স্থানীয় চিকিৎসকদের ভাইরাসের মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ভারত সরকার একটি র‌্যাপিড রেসপন্স টিম গঠন করেছে। নেপালে ও কুয়েতে সেই মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও ভুটান, মালদ্বীপ, আফগানিস্থান, মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে একটি করে র‌্যাপিড রেসপন্স টিম পাঠানোর প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে ভারত। 

করোনা মোকাবেলায় পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে সহায়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই তাদের এই উদ্যোগ। বন্ধু দেশগুলোর প্রতি পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী ভারত এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব দেশে করোনা মোকাবিলায় মাঠে নেমে সহায়তা করবে এই বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টিম। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে করোনা মোকাবিলায় করোনাকালীন সহায়তার জন্য বাংলাদেশেও ১৪ সদস্যের একটি র‌্যাপিড রেসপন্স টিম পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছে ভারত সরকার।  

আর বিপত্তিটা বাধে সেখানেই। অনেকটা হঠাৎ করেই একটি স্বনামধন্য ইংরেজি গণমাধ্যম শিরোনাম করে 'বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভারতীয় সেনা'! শিরোনাম কি প্রেক্ষিতে কেমন হওয়া উচিত সে ব্যাপারে যত্নশীল না হয়ে গণমাধ্যমের এমন শিরোনাম জনগণের কাছে ভুল বার্তা দেয়। এই বিষয়টা গণমাধ্যমের মাথায় রাখা উচিত। এমন ভুল সংবাদ বা ভুল শিরোনামে জনমনে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। যেমনটা এই সংবাদের ক্ষেত্রে হয়েছে। অথচ কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরু থেকেই ভারত সরকার নানাভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। ১৫ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সার্কের নেতাদের সাথে এক ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন। পরবর্তীতে ভারত ১০ মিলিয়ন ডলারের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে সার্ক কোভিড-১৯ জরুরি তহবিল গঠন করে৷ এই তহবিলের অধীনে প্রথম দফায় ৩০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক এবং ১৫ হাজার হেড কাভার দেয়া হয় বাংলাদেশকে। ২৫ মার্চ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেনের নিকট তা হস্তান্তর করা হয়। আর ২৫ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় ১০ লাখ হাড্রোক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট ও ৫০ হাজার সার্জিক্যাল লেটেক্স গ্লাভস ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে দেয়া হয়। এছাড়াও করোনা সংক্রমণ বিস্তার রোধে ডাক্তার, নার্সদের আলাদা প্রশিক্ষণ চালু করেছে ভারত সরকার যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের আলাদা প্রশিক্ষণও তারা দিচ্ছেন। 

করোনা সমস্যা সমাধানে যখন পাশের রাষ্ট্র ভারত এতো সহায়তা দিচ্ছে সেখানে অনেকটা হঠাৎ করেই অপপ্রচার শুরু করে দিলো যে, বাংলাদেশে ভারতীয় সেনা প্রবেশ করছে! তার মানে এই সংবাদটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়ানো হয়েছে। এই বিপর্যস্ত সময়ে যখন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত তখন আমাদের পাশে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই কিনা আমরা কুৎসা  রটাতে উদ্যত হলাম! ভারত যেখানে বললো র‌্যাপিড রেস্পন্স টিম পাঠানোর কথা, আমাদের এক গণমাধ্যম ভারতীয় সেনা আসছে বলে সংবাদ প্রকাশ করে দিলো। আর সংবাদের সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই সোশাল মিডিয়ায় একদল প্রচারে লিপ্ত হয়ে গেলো। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বা ভারতের পক্ষ থেকে কি সংবাদ এসেছে তা একবারো দেখার প্রয়োজন কেউ মনে করলো না৷ এই অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে আমরা এতোটা অন্ধ কিভাবে হই! তাই সবাইকে বলবো, যেকোন তথ্য যাচাইপূর্বক তা প্রচার করুন। সংবাদমাধ্যমের সাথে জড়িত কর্তাব্যক্তিদেরও মাথায় রাখা উচিত, ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেনো গণমাধ্যমের হলুদ সাংবাদিকতার বলি না হয়!

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর