২ জুন, ২০২০ ১৩:৩২

প্রিন্সেস ডায়ানার শেষকৃত্য ও মোস্তফা কামাল সৈয়দ

সৈকত রুশদী

প্রিন্সেস ডায়ানার শেষকৃত্য ও মোস্তফা কামাল সৈয়দ

সৈকত রুশদী

বাংলাদেশে সম্প্রচার মাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশন মাধ্যমের অনন্য এক সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল সৈয়দ। তাঁর চিরবিদায়ে যে ক্ষতি হলো বাংলাদেশের গণমাধ্যমে, তা অপূরণীয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) আমি ১৯৭৮ সালে প্রথম কাজ করলেও তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল সম্ভবত আশির দশকে, বিটিভি ভবনে। ১৯৮২ সালে যখন আমার স্কুল ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজের (বর্তমানে বিজ্ঞান কলেজ) প্রাক্তনীদের পুনর্মিলনীর উদ্যোগ নিই আমরা কতিপয় তরুণ, তখনই জানতে পারি তিনিও একই বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থী ছিলেন। ঢাকা, লন্ডন ও টরন্টোয় টেলিভিশনে আমি টুকরো টুকরো কিছু কাজ করলেও বেতার ও মুদ্রণ মাধ্যমের তুলনায় এই মাধ্যমটিতে আমার খুব বেশি বা ধারাবাহিকভাবে কাজ করা হয়নি। টেলিভিশন মাধ্যমের এই নেপথ্য নায়কের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ছিল বরাবরই। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি একবারই এবং সেটি ছিল চিরস্মরণীয় একটি অনুষ্ঠানের সম্প্রচার নিয়ে। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আমি তখন ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে প্রেস অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা।

যুক্তরাজ্যের সাবেক যুবরাজ্ঞী প্রিন্সেস ডায়ানা প্যারিসে এক রহস্যময় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩১ আগস্ট ১৯৯৭। তিনি তখন রাজপরিবারের সদস্য না হলেও হাইকমিশনে শোক বই খোলা হয়েছে। সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে আসলেন বারিধারায় হাইকমিশন ভবনে শোক বইতে স্বাক্ষর করতে। তাঁকে স্বাগত জানানো থেকে শুরু করে বিদায় দেওয়া পর্যন্ত সঙ্গে ছিলাম। দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে।

আরও মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনীতিককেও একইভাবে স্বাগত জানাতে হয়েছে। বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয় প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু পরবর্তী গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের বিপুল উৎসাহ তাঁকে নিয়ে। অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে শুরু করে, তাঁর স্থিরচিত্র এবং ভিডিও চিত্রের অনুরোধ রক্ষায় প্রেস অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগটি প্রচন্ড ব্যস্ত সে সময়।

এর মধ্যে সম্ভবত ৪ সেপ্টেম্বর ফোন করলেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। বিটিভি থেকে। জানালেন, বিবিসি থেকে লন্ডনে ৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় প্রিন্সেস ডায়ানার শেষকৃত্যের সরাসরি (লাইভ) সম্প্রচার বিটিভি থেকে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু বিবিসি বিনামূল্যে লাইভ ফিড দিতে রাজি হয়নি। বিটিভির পক্ষে এত কম সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় বিবিসিকে লাইভ ফিডের ফি দেওয়ার অনুমোদন নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি এই শেষকৃত্য সরাসরি সম্প্রচার করতে চান দর্শকদের চাহিদার কথা ভেবে, আমাকে সাহায্য করতে হবে। আমিও বাংলাদেশে প্রিন্সেস ডায়ানার জনপ্রিয়তা ও দর্শক চাহিদার কথা ভেবে সম্মত হলাম যতটা সম্ভব সাহায্য করতে। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ব্রিটেন ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এ নিয়ে হাইকমিশনে নিয়মিত এক বৈঠকে আমি প্রিন্সেস ডায়ানার বাংলাদেশ সফরকে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছিলাম এই দুর্ঘটনার বছর কয়েক আগেই। এক ব্রিটিশ সহকর্মী আমার প্রস্তাব শুনেই বলেছিলেন, তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই। বিচ্ছেদ না হলেও তখন যুবরাজ প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানা আলাদা বসবাস করছেন। পরে প্রিন্স চার্লস এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে। সে আরেক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে হাইকমিশনের পক্ষ থেকে আমি লিখলাম লন্ডনে হোয়াইট হল ভবনে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের সংশ্লিষ্ট দফতরে। আর বিবিসি টেলিভিশনের সদর দফতরে। বিটিভির অনুরোধ পত্রের কপিসহ। দুই স্থান থেকেই ত্বরিত প্রাপ্তি স্বীকার পেয়ে আমি ধরেই নিলাম বিটিভির জন্য বিনামূল্যে বিবিসির লাইভ ফিডের অনুমোদন সময়মতোই পাওয়া যাবে। জানিয়ে দিলাম, মোস্তফা কামাল ভাইকে। কিন্তু নাহ। 

প্রিন্সেস ডায়ানার শেষকৃত্যের দিন, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭, সকালে আমাকে অফিসে ফোন করে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে মোস্তফা কামাল ভাই বললেন, এখনো অনুমোদন আসেনি। সম্ভবত বিকাল ৩টায় শুরু হবে বিবিসির সরাসরি সম্প্রচার। প্রিন্সেস ডায়ানার শেষকৃত্যের। বিটিভি থেকে আগাম ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন তিনি। আমাকে যে করেই হোক আগাম অনুমোদন আনাতেই হবে। অগ্রজতুল্য মোস্তফা কামাল সৈয়দ ভাইয়ের অনুরোধে লন্ডনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিবিসিকে তাগিদ দিতে আবার চিঠি পাঠালাম ফ্যাক্স করে। ফোনও করলাম হোয়াইটহলে। আমাকে বলা হলো, অগ্রগতির কথা। তবে বিবিসির অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত যেন বিটিভি সম্প্রচার শুরু না করে। এদিকে মোস্তফা কামাল ভাই ফোন করেই যাচ্ছেন খানিক পরপরই। বেলা আড়াইটায় অফিস ছুটির পর কিছুক্ষণ থাকলাম বিবিসির অনুমোদনসহ ফ্যাক্সের অপেক্ষায়। এলো না। ফোন করলাম লন্ডনে বিবিসি টেলিভিশনে। উদ্দিষ্ট কর্মকর্তাকে না পেয়ে ভয়েস মেসেজ রাখতে হলো। মন খারাপ করে নিকুঞ্জতে বাসায় ঢুকেছি। ৩টা বাজতে মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি। মোস্তফা কামাল ভাই ফোনে বললেন সব কিছু লাইন আপ করা আছে। তিনি অপেক্ষায়। তার পরই লন্ডনে বিবিসি থেকে আমাকে ফোন করে জানাল, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুরোধে তারা অনুমোদন দিয়েছে বিটিভিকে বিনামূল্যে সরাসরি সম্প্রচারের। অনুমোদনপত্র ফ্যাক্সযোগে হাইকমিশন ও বিটিভিকে পাঠানো হবে। আপাতত সম্প্রচার শুরু করা যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মোস্তফা কামাল সৈয়দ ভাইকে ফোন করে নিশ্চিত করলাম। ৩টা বাজতে তখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি। পরদিন তিনি ফোন করে ধন্যবাদ জানানোর সময় বললেন, ‘আমি জানতাম আপনি বিবিসি’র অনুমোদন আদায় করে আনতে পারবেন।’ ২০১৬ সালে কারওয়ান বাজারে এনটিভিতে বন্ধু খায়রুল আনোয়ার মুকুলের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়েছিলাম। তখন মুকুলের সঙ্গে মোস্তফা কামাল সৈয়দের কক্ষে গিয়ে দেখা করলাম। তিনি সহাস্যে স্মরণ করলেন প্রিন্সেস ডায়ানার শেষকৃত্য সম্প্রচারের নেপথ্যে আমাদের দুজনের যৌথ প্রচেষ্টার কথা। সে শেষ দেখা। পরে জেনেছি, অনুষ্ঠানের মান নিয়ে আপসহীন মোস্তফা কামাল সৈয়দ এভাবেই কাজ আদায় করে নিতেন মানুষের কাছ থেকে। বাংলাদেশের টেলিভিশন মাধ্যমে মোস্তফা কামাল সৈয়দের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, প্রত্যেকের হৃদয়ে লেখা থাকবে তাঁর নাম ও স্মৃতি।

লেখক :  জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রেডিও, টেলিভিশন ব্রডকাস্টার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বর্তমানে টরন্টো, কানাডায় বসবাসরত।

সর্বশেষ খবর