২৫ এপ্রিল, ২০২১ ০৮:৫৬

সময়ের থিওরি থেকে বেরিয়ে আসুক মানুষ

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

সময়ের থিওরি থেকে বেরিয়ে আসুক মানুষ

পৃথিবীর পরিবর্তনগুলো কি আমরা লক্ষ্য করি। কখনো কখনো এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটে। আবার কখনো কখনো এই পরিবর্তন দ্রুত ঘটে যায়।  তবে এই পরিবর্তনগুলো থেকে মানুষের অনেক শেখার বিষয় থাকলেও মানুষ তা শিখে না। যতক্ষণ মানুষ তার জীবন হাতে নিয়ে মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকে ততক্ষন মানুষ ভাবে তার থেকে আর শক্তিশালী মানুষ পৃথিবীতে নেই। অথচ মানুষ যদি উল্টো করে ভাবতো তবে মানুষ পৃথিবীর পরবর্তনগুলো দেখতে পেতো। সে পরিবর্তন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে পাল্টে ফেলতে পারতো।

মানুষের চোখের সামনে সময়ের একটু একটু করে পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হয়। সময় সে পরিবর্তনের প্রভাব মানুষের উপর ফেলে মানুষকে পরখ করার পরিবেশ তৈরী করে। অথচ মানুষ সে সময় থেকে যেটা জানতে পারতো সেটা জানার চেষ্টা করে না। সময়ের খেলা খুব অদ্ভুত। সময়ের খেলায় কেউ রাজা হয়, কেউ ভিখারি হয়। সময় মানুষকে সন্মান দেয়, মর্যাদা দেয়। আবার এই সময়ই নির্মম হয়ে মানুষের সন্মান ও মর্যাদা কেড়ে নেয়। সময় সময়ের আগেই মানুষের মৃত্যুর খবর আনে। আবার দুঃসহ জীবন নিয়ে যে বেঁচে থাকতে চায়না তার মৃত্যুর খবরটা জানাতে সময় এতটা দেরি করে যে সে মানুষটার কাছে বেঁচে থাকাটা মরে যাবার থেকেও কঠিন হয়। সময়ে অনেক কিছু হারিয়ে যায়, আবার অনেক নতুন উপাদানের জন্ম হয়। সবাই নতুনটাকে দেখে। নতুনের প্রেমে পড়ে যায়। অথচ হারিয়ে যাওয়া পুরাতনের মধ্যেও যে মহামূল্যবান সম্পদ থাকে মানুষ তা জানতেও চায় না। তবে সময়ের পরীক্ষাটা খুব কঠিন। সবাই এই পরীক্ষায় জিততে পারে না। তবে আমরা যেভাবে মানুষের  জয় পরাজয় দেখি। সময়ের জয় পরাজয় তেমনটা না। 

আমরা যাদের হারতে দেখছি হয়তো সময়ের পরীক্ষায় তারা জিতছে। আর যাদের জিততে দেখছি তারা হয়তো সময়ের পরীক্ষায় হারছে। সালভাদর দালির বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য পারসিস্ট্যান্স অব মেমোরি'তে এক একটা বিলুপ্ত সময়কে তুলে ধরা হয়েছে। অনেকটা বিলুপ্ত ডাইনোসারের মতো। এ ছবির প্রধান চরিত্র ঘড়ি। যে ঘড়িগুলো এখন অতীত সময়ের চিহ্ন বহন করছে। যেখানে ঘড়ির কাটায় আটকানো সময়গুলো কাপড়ের  মতো ঝুলে পড়েছে শূন্যতায়। কখনো মরা গাছে ঠাই নিয়েছে সময়। কখনো কাঠের তৈরী ডাইনিং টেবিলের গা বেয়ে পানির মতো গড়িয়ে পড়েছে সময়। কখনো পিঁপড়াদের আক্রমণের শিকার হয়েছে রসে ভেজা চমচমের মতো লোভনীয় সময়। পাহাড়, আকাশ, সাগর যেন সে সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বোবার মতো। যারা জানতো সে সময়টা একসময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখন নেই। 

সব সময় ইতিহাস হয় না, সব মানুষ সময়ের সাথে অমরত্ব পায় না। হয়তো যে সময়টা ইতিহাস হয় না, যে মানুষরা সময়কে জয় করে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়না, সে সময়ের কল্পনা করেছেন সালভাদর দালি। সময় এমন করেই সময়কে অতিক্রম করে হয়তোবা। মানুষকে এক সময়ের গন্ডি পেরিয়ে আরেক সময়ে যাত্রী হবার পথ দেখায়। সবাই সে পথ দেখতে পায় না। কারণ সে পথ চোখ দিয়ে দেখা যায় না। সে পথ জীবনবোধের মূল্য দিয়ে দেখতে হয়। সে সময় ত্যাগ দিয়ে দেখতে হয়। সে সময় মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে দেখতে হয়। যেখানে জীবন, ত্যাগ আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সময়কে অতিক্রম করে সময়ের চেয়ে মানুষকে মূল্যবান করে তুলে। সেখানে সময়ের শক্তির চেয়ে মানুষের নান্দনিকতার শক্তি অনেক বেশি। 

ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়ান বারবার আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের উপর কলোগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিনের মতো তিনিও তার মতো যুক্তি দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেন সময় বলে আসলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই, এটি শুধুমাত্র মস্তিষ্কের কল্পনা। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তার “The End of Time” বইয়ের মাধ্যমে তিনি সময়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে নতুন মতবাদ গড়ার চেষ্টা করেন। আবার অ্যারিস্টটল, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন সময়ের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হলেও তাদের সময়কে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তাহলে সময় থাকা না থাকা নিয়ে একটা ঠান্ডা লড়াই পৃথিবীতে আছে। 

অথচ সময়কে আটকে রাখতে মানুষের ঘড়ি বানানোর যাত্রাটা চলেছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। মিশরীয়রা আবিষ্কার করেন সূর্য ঘড়ি বা ছায়া ঘড়ি। জার্মানরা আবিষ্কার করেন তারা ঘড়ি। খ্রীষ্ট পূর্ব ১৪০০ সাল নাগাদ মিশরীয়রা আবার পানি ঘড়ি আবিস্কার করেন। সময়ের আবর্তনে প্রায় বারোশ বছর আগে বালুঘড়ি আবিষ্কৃত হয়। এরপর চীনদেশে আবিষ্কৃত হলো মোমঘড়ি। সে সময় প্রকৃতি ও প্রকৃতির উপাদান ছিল সময় যাচাইয়ের মাধ্যম। অথচ একসময় প্রকৃতির হাত ছেড়েছে মানুষ। হাত ধরেছে যান্ত্রিকতার। বানিয়েছে যন্ত্র ঘড়ি। এসেছে যান্ত্রিক সময়। যাত্রীকে মানুষ। সময় তার প্রয়োজনে মানুষের হাতে বন্দি হয়েছে নাকি সময় তার প্রয়োজনে মানুষের হাতে তাকে বন্দি করেছে, কে জানে। কেইবা বলতে পারে। হয়তো সময় সব সময় স্বাধীন থেকেছে। মানুষকে অভিনয় করে দেখাচ্ছে সে মানুষের হাতে বন্দি। সময় হয়তো এভাবে স্বপ্রনোদিত হয়ে বন্দি হয়ে মানুষকে পরখ করছে। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে, মানুষ সময়ের লাগাম টেনে কতটা সীমা অতিক্রম করতে পারে। কতটা প্রতারক হতে পারে। কতটা স্বার্থপর হতে পারে। যদি বলি সময় ছিলোনা কিন্তু মানুষ তার প্রয়োজনে সময় বানিয়েছে। সময়ের সে না থাকাটাই হয়তো সময়, সেটাই সময়ের শেকড়, সময়ের শক্তি। আর মানুষের বানানো সময়টা মানুষের মতোই অসুস্থ, সেটা অনেকটা স্বাধীন সময়ের শেকড়ের কাছে গজিয়ে উঠা আগাছা পরগাছার মতো। যে সময় স্বাধীন সে সময় মানুষকে প্রভাবিত না করে মানুষকে সময়ের চেয়ে বড় হবার সুযোগ দেয়। 

যে সময় মানুষের হাতে গড়া সে সময় মানুষকে মানুষের  হাতের খেলার পুতুল বানায়। মানুষকে ছোট করে। মানুষকে পিরামিডের ভিতর ভরে রেখে মমি বানায়। মানুষ প্রতিদিন মমি হয়ে মৃত মানুষের চিহ্ন হোক এটাই তো আমরা চাইনা। আমরা চাই সে মানুষ যে মানুষ সময়কে পিছে ফেলে প্রতিদিন মানুষের মতো মানুষ হবে। যে মানুষ থেমে যাবেনা বরং স্থিরতার ইটপাথরের ঢালাইকে বরফ বানিয়ে পানিতে রূপান্তর করবে। যেখানে কঠিন হবে তরল। তরল হবে বায়বীয়। সেখানে মানুষ ডানা ছাড়া উড়বে নিজের শক্তিতে। দ্য টাইম মেশিন হারবার্ট জর্জ ওয়েলস রচিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর একটি বইটি। যা ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৬০  সালে মার্কিন পরিচালক জর্জ পাল এটিকে চলচিত্রে রূপ দেন। 

কাহিনীটা মোটামুটি এরকম: ১৯০০ সালের ৫ জানুয়ারি ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ড-এর একজন বিজ্ঞানী টাইম মেশিন নামের  যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। সে যন্ত্রের মাধ্যমে যে কোনো সময়ে ভ্রমণ করা যায়। সেটা হতে পারে অতীত কিংবা ভবিষ্যত। যন্ত্রটি ব্যবহার করে বিজ্ঞানী ভবিষ্যতে চলে যান। ভবিষ্যতের কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে তিনি দেখতে পান মানবজাতির বংশধরেরা দুই প্রজাতিতে বিভক্ত হয়, এক প্রজাতি শিশুদের মত দেখতে এলয় এবং আরেক প্রজাতি ভূ-অভ্যন্তরবাসী মর্লক যারা এলয়দের খেয়ে বেঁচে থাকে। মর্লক ও এলয়দের সম্পর্ক প্রভু ও ভৃত্যের মতো  নয় বরং খাদক ও খাদ্যবস্তুর মতো। খুব অদ্ভুত একটা দর্শনতত্ত্ব যেখানে মানুষ মানুষকে খায়। হয়তো পুরো বিষয়টা প্রতীকী। যার অন্য কোনো ভাবার্থ আছে। তবে এমন মনোভাবটাই তো এখন মানুষের ভিতর তৈরী হয়েছে। কখনো মানুষ মানুষের  দ্বারা শোষিত হচ্ছে। কখনো মানুষের রঙ্গলীলার শিকার হচ্ছে মানুষ। কখনো দুর্নীতিবাজদের করাল গ্রাসে নিপতিত হচ্ছে মানুষ। কখনো দেশের  টাকা বিদেশে পাচার হয়ে মানুষের দ্বারা বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। কখনো অন্ধত্বের বেড়াজালে আটক পড়ছে মানুষ। কখনো মন্দ সেজে, কখনো ভালো সেজে মানুষ মানুষকে নিয়ে খেলছে। টাকায় মানুষ  কেনা বেচা হচ্ছে। কখনো গোষ্ঠীবদ্ধতার জোরে, কখনো পেশিশক্তির জোরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে মানুষ। কখনো লোভ, স্বার্থপরতা, অহংকার, কুসংস্কারের শিকার হচ্ছে মানুষ। এই অন্ধকারের রোগ ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে। সারা পৃথিবীর মানুষের ভিতরে। সব দায় কি সময়ের। নাকি মানুষের। সেটা ভাবতে হবে মানুষকেই। কারণ পৃথিবী থাকলেই মানুষ থাকবে। মানুষ থাকলেই সময় থাকবে। সময় যা জানে মানুষ তা জানে না, মানুষ যা জানে সময় তা জানে না। এই জানা-অজানাটা একটা বিন্দুতে এসে মিলতে হবে। তবেই হয়তো অদেখা সমীকরণটা মিলবে। তখন সেটা থিওরি না থেকে বাস্তবতা হয়ে যাবে। 

বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর