ভারতের অন্যতম আঞ্চলিক দল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় তৃণমূল কংগ্রেস ভাঙনের পথে! অতি সম্প্রতি কলকাতায় তৃণমূল দলের জেলা কর্মকর্তাদের ডেকে মমতা বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে বছর দুই আগে থাকতেই। নব-তৃণমূল, আদি তৃণমূলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। মমতা তার ভাষণে দলের সাধারণ সম্পাদক তার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে খানিকটা দাবিয়ে দিয়ে বলেছেন, প্রবীণরাই দল চালাবেন, নবীনরা নয়। মমতার এ উক্তিতেই প্রবীণদের বুকে একটু বল ফিরেছে। কারণ আস্তে আস্তে দল থেকে প্রবীণদের যিনি ছেঁটে ফেলেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, মমতার ভাইপো। যত কেচ্ছা এই ভাইপোকে নিয়ে। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে তদন্তকারী এজেন্সিগুলো ভাইপোকেই ডাকছে। কয়লা থেকে মিডডে মিল কী নেই সেই দুর্নীতির তালিকায়। তাতেই তাদের দলের প্রবীণদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। দলটি কে চালাবে? পিসি, না ভাইপো? পিসি দলের ওই সভায় ভাইপোকে ডাকেননি। এমনকি সভাস্থলে তার কোনো ছবিও রাখা হয়নি। দিদি তার জনসভায় স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি বিজেপিকে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু গান্ধী হত্যাকারী আরএসএস-কে বিশ্বাস করেন। তার এ বক্তব্যে সারা ভারতে প্রশ্ন উঠেছে, মমতা কি তাহলে এতদিন আরএসএসের সাহায্যেই নির্বাচনে জিতে আসছিলেন? গান্ধী হত্যাকারী, স্বাধীনতা আন্দোলনবিরোধী আরএসএসকেই মমতা এখন সম্বল করতে চাইছেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ইন্ডিয়া জোটের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। একই দিনে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলা উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন- বাংলাদেশ থেকে যে কয়েক হাজার লোক এপারে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সবাইকে ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড করে দিচ্ছি এবং দেব। এ দুটি মন্তব্য নিয়েই বিরোধীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ইন্ডিয়া জোটের সবাই একবাক্যে বলছেন, মমতা নিজের কথা নিজেই ফাঁস করে দিলেন? পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম সম্পাদক মুহম্মদ সেলিম সরাসরি মমতাকে আক্রমণ করে বলেছেন- মমতা কী করে গোপনে গোপনে আরএসএসের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন? এ কথা আমরা আগেই বহুবার বলেছি। ২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৪২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মমতা যে আবার আরএসএসকে নিয়ে চলবে সেটা এখন পানির মতো পরিষ্কার। পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, গোড়া থেকেই মমতাকে এ জোটে নেওয়ার বিরোধী ছিলেন তিনি। এখনো আছেন। সুতরাং আগামী লোকসভা নির্বাচনে মমতা আরএসএস ধরেই এগোতে চাইছেন। গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকেও মমতা এখন ঊর্ধ্ব আসনে বসিয়ে তার পূজা করতে শুরু করেছেন। ভারতের মানুষ মমতার এ দুমুখো নীতি মানছে না, মানবে না। পিসিকে আক্রমণ করার জন্য ভাইপো আসরে নামিয়েছে দলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষকে। নেতাজি ইন্দোরে হয় তৃণমূলের এ বিশেষ অধিবেশন। তার আগে কিছু মতপার্থক্যের কারণে দলের মধ্যে সামগ্রিকভাবে সরে থাকার ইঙ্গিত ছিল অভিষেককে ঘিরে। দলের এ অধিবেশনের প্রস্তুতি ঘিরে সেই সরে থাকার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছিল। এবার তা সামনে নিয়ে এসেছেন কুনাল ঘোষ। একবারে শীর্ষস্তরে যে সিদ্ধান্ত হচ্ছে- তার জেরে সরকারকে আদালতে ধাক্কা খেতে হচ্ছে এবং শাসক দলের মুখপাত্র হিসেবে সে সবের পক্ষে সওয়াল করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
প্রবীণদের গুরুত্ব দেওয়া মানে কি পদ আঁকড়ে থাকা, নেতাজি ইন্দোরের সভায় কেন অভিষেকদের কোনো ছবি ছিল না, এসব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। দল ও সরকার সম্পর্কে এ প্রশ্নগুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ এসব সিদ্ধান্তের বেশির ভাগই তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির নেওয়া। স্বভাবতই শাসক শিবিরের অন্দরে প্রশ্ন- কুনালরা প্রকাশ্যে যা বলছেন, তার নেপথ্যে কি মেঘের আড়ালে কোনো মেঘনাদ আছেন? দলের একাংশের মতে, কুনালের তোলা প্রশ্নে অভিষেক শিবিরের ক্ষোভের প্রতিধ্বনি আছে। শাসক দলের সবচেয়ে সরব মুখপত্রের ভিন্ন সুরের পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূলের তরফে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি। তবে দলের অপর এক সাংসদ তথা আইনজীবী নেতা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কে কী বলছেন, জানি না। যা নিজে শুনিনি, তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। আমাদের দল একটা পরিবারের মতো। সেখানে মমতা ব্যানার্জিই প্রথম ও শেষ কথা। এ নিয়ে কোথাও কোনো বিভ্রান্তির জায়গা নেই। কয়েক বছর ধরে তৃণমূলে নবীন ও প্রবীণদের টানাপোড়েন ছিল। অভিষেক সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর দল ও সরকারে নবীনদের উত্থান গুরুত্ব পায়। কোণঠাসা হয়ে পড়েন প্রবীণদের একটা বড় অংশ। সেদিকে ইঙ্গিত করে নেতাজি ইন্দোরের সভায় মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রবীণদের সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। বয়সের কারণে কেউ যেন বাদ না পড়েন। সেই সঙ্গে তার খোঁচা দেহত্যাগ না করলে পদত্যাগ নয়, ও তো ভালো কথা নয়। তার আরও মন্তব্য- আমি নিজে আর কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাই না। দলকেও তা জানিয়ে দিয়েছি। সারদা কাজে পুলিশকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য জোগাড় করা হয়েছিল, তা নিয়েও সরব হন কুনাল ঘোষ। জেলযাত্রার ১০ বছরপূর্তিতে এ নিয়ে কুনাল সমাজিকমাধ্যমে যা পোস্ট করেছিলেন তাতে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল।
দলের পাশাপাশি সরকারের কাজকর্ম নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে বিজেপির সমাবেশে আপত্তি করে রাজ্য সরকার যে প্রশাসনিক ও আইনি লড়াইয়ে এগিয়েছে তাও অগণতান্ত্রিক বলে মন্তব্য করেছেন তৃণমূলের মুখপাত্র। তার কথায় কিছু কিছু বিষয়ে মুখপাত্র হিসেবে সরকারের কাজ সমর্থন করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। যেটা বিষয় নয়, সেটাও প্রচারের বিষয় হয়ে যাচ্ছে। যারাই সরকারকে এরকম পরামর্শ দেন না কেন? এরকম হলে মুখপাত্র হিসেবে সরকারের পক্ষে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যায়। বিগত শতকে ১৯৯৭ সালে কংগ্রেস ভেঙে বিজেপির হাত ধরে মমতা দিল্লি পৌঁছেছিলেন। সে সময় যারা তাকে মদদ দেন, তাদের অনেকেই এখন তৃণমূলে। তারা সবাই প্রবীণ। এই ডিসেম্বর মাসেই বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল। মমতা তখনো বলেছিলেন, আরএসএস একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ দল। সিপিএম/কংগ্রেসের মতো তারা হারমাদ নয়। মততা ক্ষমতায় এসে আরএসএসকে ঢালাও সুবিধাও দিয়েছেন। যে বিজেপি আরএসএসের নামও পশ্চিমবঙ্গে কেউ জানত না, তাদের কোনো অস্তিত্বই সেভাবে ছিল না, সেই আরএসএসকে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ৮০০-এর অধিক স্কুল খোলার সুযোগ করে দিয়েছেন মমতা স্বয়ং। পিসি-ভাইপোর দ্বন্দ্ব কি আদৌ মিটবে? নাকি অভিষেক মমতার মতোই মূল দল ভেঙে আরেকটি দল করবেন- এ প্রশ্ন নিয়ে এখন গোটা বাংলা তোলপাড়।
লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        