ঢাকা শহরে মশার ঘনত্ব প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে মশার লার্ভার ঘনত্ব এবং উড়ন্ত মশার ঘনত্ব বেড়েছে কয়েক গুণ। মার্চে এই ঘনত্ব চরমে পৌঁছবে। গত বছরের জুন-জুলাইয়ের তুলনায় মার্চে মশার ঘনত্ব বাড়তে পারে চার-পাঁচ গুণ। ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে একই অবস্থা হতে পারে।
গত বছরের কয়েক মাসের তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় মশার লার্ভার ঘনত্ব প্রতি ডিপে গড়ে ১২ থেকে ১৭ ছিল, কিন্তু এখন তা বেড়ে ৮৭-এরও বেশি হয়ে গেছে। উড়ন্ত মশার ঘনত্ব গত বছর পার ম্যান পার আওয়ার (প্রতি ঘণ্টায় কামড়ায়) গড়ে ২৫-এর নিচে ছিল। এখন তা বেড়ে ৩০০-এরও বেশি হয়ে গেছে।
এই ঘনত্বটি ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে আরো বাড়বে এবং এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে চরমে পৌঁছাতে পারে।
মশার ঘনত্বের এই দ্রুত বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। শীতকালে যেসব মশার ডিম এবং লার্ভা পানিতে থাকে, বসন্তে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো দ্রুত পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তরিত হয়। ফলে মশার সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।
এ ছাড়া দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হওয়া, বিশেষ করে শীতের শেষে, ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল, ঝিল এবং খালের পানির ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। এসব স্থানে জমে থাকা পানিতে জৈব উপাদান বৃদ্ধি পায়, যা মশার লার্ভার জন্য আদর্শ খাদ্য। এই পরিস্থিতি মশার প্রজননের জন্য একেবারে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে মশার ঘনত্ব মোকাবেলা করার জন্য কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই জরুরি। প্রথমত ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল, ঝিল এবং খাল পরিষ্কার করে সেখানে লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত।
তবে শুধু কীটনাশক প্রয়োগ করলেই হবে না, বরং আগে মশার প্রজননস্থানগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে, কীটনাশক শুধু লার্ভার ওপর কাজ করে, কিন্তু যদি পানি পরিষ্কার না করা হয়, তাহলে কীটনাশক কাজ করবে না এবং নতুন লার্ভা আবার জন্মাবে।
মশার লার্ভা মারার জন্য বিশেষত প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া বিটিআই ব্যবহারের করা যেতে পারে। এটি একটি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, যা মশার নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। উড়ন্ত মশা নিধনে সিটি করপোরেশনগুলো বিভিন্ন জায়গায় ফগিং করলেও মশা নিয়ন্ত্রণে এর কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। এটি ব্যবহার করলেই সমস্যা সমাধান হবে না, বরং এটি একটি সাময়িক পদক্ষেপ। দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল পেতে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল, ঝিলে মশা খেকো গাপ্পি মাছ ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। গাপ্পি মাছ মশার লার্ভা খেয়ে থাকে এবং খুব দ্রুত তা খেয়ে মশার ঘনত্বকে প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখে। গাপ্পি মাছের মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ পরিবেশবান্ধব এবং খুবই কার্যকরী একটি পদ্ধতি।
মশার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ নাগরিকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নাগরিকদের উচিত তাদের বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত জমি কিংবা নির্মীয়মাণ ভবনে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলা বা পরিষ্কার রাখা। এর মাধ্যমে নাগরিকরা মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রিত করতে পারে, যা মশার বিস্তার কমানোর একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে এই কাজগুলো পরিচালনা করতে হবে। যদি সিটি করপোরেশন এবং সাধারণ নাগরিকরা একযোগে কাজ করে, তবে মশার সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে, বিশেষত ফেব্রুয়ারি মাসে মশার ঘনত্ব বৃদ্ধির আগে এই সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আমাদের সবার সচেতনতা, সঠিক পদক্ষেপ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা মশার বিস্তার রোধ করতে পারব এবং মানুষের জীবনযাত্রাকে নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে পারব।
বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশ মশার প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। মশা এমন একটি পতঙ্গ, যেটি পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। স্থানভেদে মশার প্রজাতি এবং আচরণও ভিন্ন হয়। দেশে বর্তমানে ১২৬টি মশার প্রজাতি চিহ্নিত হয়েছে। ঢাকায় মশার প্রজাতির সংখ্যা ১৬টি পর্যন্ত রয়েছে। তবে সব প্রজাতির মশা রোগ ছড়ায় না। বাংলাদেশে ১২৬ প্রজাতির মশার মধ্যে কেবল ২২টি প্রজাতি রোগ ছড়াতে সক্ষম। এর মধ্যে কয়েকটি প্রজাতির মশা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া এবং জাপানি এনসেফালাইটিসসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের বাহক হয়ে থাকে।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রধানত এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, ম্যালেরিয়া এনোফিলিস মশার মাধ্যমে, ফাইলেরিয়া কিউলেক্স মশার মাধ্যমে এবং জাপানি এনসেফালাইটিস কিউলেক্স ও ম্যানসোনিয়া মশার মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। এসব রোগের কারণে জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও সব প্রজাতির মশা রোগ ছড়ায় না, তবে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তা মানুষের জন্য ব্যাপক অস্বস্তি এবং বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মশার ঘনত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের কামড়ের ফলে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয় এবং হাজারো মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক : কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক ও অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিডি প্রতিদিন/কেএ