বাফুফের আগের নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত বছর অক্টোবর মাসে নতুন-পুরনো সংগঠক সমন্বয়ে কমিটি নির্বাচিত হয়েছে এবং তারা দায়িত্ব নিয়েছে। এটি কিন্তু সব কিছু নয়। ফুটবলে একটি মূল স্বপ্ন আছে। আর এই স্বপ্ন এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি ডালপালা মেলেছে।
ফুটবলকে ঘিরে চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত লক্ষণীয় হচ্ছে। অতএব সম্মিলিতভাবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বপ্নের পথ ধরে হাঁটাই আসল বিষয়। ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থে অযথা হিংসা, বিরুদ্ধাচরণ, সমালোচনা এবং মতলবি অসত্য প্রচারণার ফলাফলের অভিজ্ঞতা তো ফুটবলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কম হয়নি। অতএব খাল কেটে কুমির না আনা কিংবা ন্যাড়া মাথায় বেল তলায় না যাওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার।
সবাই তো সব সময় ফুটবলের স্বার্থের কথা বলেন। মনে রাখতে হবে, মতলব হাসিলের জন্য ফুটবল চত্বরকে অশান্ত করা, বিতর্কিত করার খেসারত তো মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ নয়, পুরো জাতিকে বহন করতে হবে।
ফুটবলে প্রয়োজন রূপান্তর। এখন পর্যন্ত নির্বাচিত কমিটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এই চেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে হবে নতুবা আবার আমাদের অতীত সংস্কৃতিতে ফিরে যেতে হবে। সময় এবং পরিবেশ এখন অনুকূলে। সময়ের ডাক হলো সামনে তাকাও—আর নিজকে জানো ও বুঝো। অতীতে বছরের পর বছর ধরে বাফুফের নির্বাচিত কমিটির সদস্যদের অভিযোগ আর আক্ষেপ আমরা সবাই শুনেছি—কাজ করার সুযোগ থাকলেও কাজ করতে দেওয়া হয় না, কাজ করার পরিবেশ নেই। এবার এখন পর্যন্ত এ ধরনের অভিযোগ ও আক্ষেপ কানে আসেনি।
সবাইকে সম্পৃক্ত করে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
সমস্যা আছে, আছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে—তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। ফুটবলের সার্বিক অবস্থা যথাযথ মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যায় সেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শুধু সংবেদনশীলতা যথেষ্ট নয়। দরকার সংগঠকদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং সঠিক রণকৌশল। প্রয়োজন পেশাদারির। সবাই ফুটবলের ভালো চাচ্ছেন, ফুটবল পরিবেশকে সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখার কথা ভাবছেন—এমনটি ভাবার খুব বেশি সুযোগ নেই। আর সেই ইঙ্গিত তো লক্ষণীয় হচ্ছে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের উদাহরণ তো দেখছি। দেখছি ব্যক্তি, ক্লাব এবং সমষ্টির স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য উসকানির মাধ্যমে মতলবি খেলা। উদ্দেশ্য একটাই ফুটবল পরিবেশ অস্থিতিশীল করা। দেশের বাইরে বাংলাদেশের ফুটবলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা। এটি এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা।
ঐক্যবদ্ধ তারুণ্য দেশটাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। সর্বক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুনত্বের হাওয়া বইছে। মানুষ বুঝতে পারছে ঐক্যবদ্ধ মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব—শুধু প্রয়োজন দৃঢ় প্রত্যয় এবং ইচ্ছাশক্তি। এর জন্য প্রয়োজন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সংস্কৃতির চর্চাকে বেগবান করা। ফুটবলের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা।
ফুটবল ঘিরে নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করছে ফুটবলের আকাশে মেঘের পেছনে লুকিয়ে ঝকঝকে রোদ। এখন প্রয়োজন ফুটবলের ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ভালো ফুটবল পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আন্দোলন। সংগঠকদের শুধু জাতীয়তাবাদী হলে চলবে না, হতে হবে দেশপ্রেমিক। হতে হবে গণতান্ত্রিক এবং ‘প্রো-অ্যাকটিভ’। ফুটবল এখন দুনিয়াজুড়ে দেশে দেশে একটি ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবে পরিচিত। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা, নীতি, আদর্শ, সুশাসন, জবাবদিহি এবং শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পার্থক্য নেই। এ বিষয়ে আমরা ভীষণভাবে পিছিয়ে আছি। আমরা পেশাদার ফুটবলকে অনেক আগেই স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু আমরা জানি না এই ফুটবল কিভাবে চলার কথা, কিভাবে চলছে। পেশাদার ফুটবলে প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী! এএফসির লাইসেন্স দেশে কয়টি ক্লাবের আছে? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দিকে যদি তাকাই ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা প্রত্যেক দেশে বাংলাদেশ থেকে বেশি আছে। আর ভারতের কথা তো বাদ দিলাম।
মোহামেডান স্পোর্টিং এবারই প্রথম পেশাদার ফুটবলে শিরোপা জয়ের সুবাস পাচ্ছে। তারা নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে অনেক বেশি পয়েন্টে এগিয়ে আছে। ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবটি যদি শেষ পর্যন্ত শিরোপা ঘরে তুলতে পারে এটি হবে তার সমর্থক ও ভক্তদের জন্য অনেক বড় স্বস্তি। পাশাপাশি কিন্তু সচেতন মহলের মনে এক ধরনের ব্যথা অনুভূত হবে—আর সেটি হলো চ্যাম্পিয়ন হয়েও ঐতিহ্যবাহী এবং জননন্দিত এই দলটি এএফসি কাপে খেলার সুযোগ পাবে না। কেননা মোহামেডান ক্লাবের এএফসি লাইসেন্স নেই। এতে লীগের রানার্স আপ দল এএফসি ভালো খেলার সুযোগ পাবে। ক্লাব পরিচালনার ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করা ছাড়া এই পেশাদার যুগে কোনো কিছুই সম্ভব নয়। এখন সব খেলায় ব্যবস্থাপনা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অযথা হৈচৈ করে লাভ নেই—যৌক্তিক কাজগুলো করতে হবে প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির সঙ্গে।
দুনিয়াজুড়ে সব দেশে পেশাদার ফুটবল লীগ পরিচালিত হয় হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে। হোম ভেন্যু সব সময় দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হোম ভেন্যু সব সময় সমর্থক এবং দর্শকদের উচ্ছ্বাস ও আবেগের তীর্থক্ষেত্র। বাংলাদেশে প্রিমিয়ার লীগ চলছে বছরের পর বছর ধরে বসুন্ধরা কিংস ছাড়া তো কারো নিজস্ব ফিফা ও এএফসি স্বীকৃত আধুনিক ‘অ্যারেনা’ নেই। অন্য দলগুলো তো বিভিন্ন ভেন্যুকে নিজের হোম ভেন্যু পরিচয় দিয়ে খেলে থাকে। এই মাঠের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা তো বড়জোর খেলার দিন বা পরের দিন। অন্যদিকে বসুন্ধরা কিংস তার নিজ অ্যারেনায়, পরিচিত দর্শকের সামনে সব সময় খেলে। এতে হোম অ্যাডভান্টেজ পাবে এটাই স্বাভাবিক—এতে কারো হিংসা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর কথা নয়। এটি বিশ্বজুড়ে পরিচিত প্র্যাকটিস।
ভালো এবং যত্নবান মাঠে খেলার সুযোগ প্রিমিয়ার লীগের দলগুলো পায় না। এই মাঠগুলোতে ফুটবলের জন্য আধুনিক প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গের কিছুই নেই। কিছুদিন আগে আলোর অভাবে খেলা বন্ধ রাখতে হয়েছে। কেননা ফ্লাডলাইট নেই। পরে অন্য একদিন লীগ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানের বিষয়টি বাফুফে গভীরভাবে ভাবছে। কেননা এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বিশ্বাস করি অবস্থার পরিবর্তন হবে। সময় লাগবে, তবে ফুটবল উপযোগী সুন্দর পরিবেশ আমরা পাব।
বারবার লিখেছি দেশের স্বার্থে, ফুটবলের স্বার্থে সবাইকে কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্য পোষণের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। এই যে বসুন্ধরা গ্রুপ কয়েক বছর ধরে প্রিমিয়ার লীগ ছাড়া সব টুর্নামেন্টে পৃষ্ঠপোষকতা করছে, করছে ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও জেলা ফুটবল লীগ এবং টুর্নামেন্ট আয়োজনে, এটি তো কোনো দোষণীয় কিছু নয়। বরং এটি ফুটবলের জন্য ইতিবাচক। বিষয়টিকে বাঁকা চোখে দেখা হবে কেন? ফুটবলে তো স্পন্সরশিপের প্রয়োজন আছে। স্পন্সরশিপ তো এখন ক্রীড়াচর্চা বা পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যতম জ্বালানি। বসুন্ধরা গ্রুপ একটি আধুনিক অ্যারেনা নির্মাণ করেছে—এ ধরনের প্রাইভেট অ্যারেনা নির্মাণের নজির দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশে নেই। এটি তো বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। এই অ্যারেনা তৈরি করা হয়েছিল বলেই এখানে বিশ্বকাপের বাছাই, এএফসি কাপের খেলা এবং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। একটি সময় গেছে এই অ্যারেনা না থাকলে আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হতো না ঢাকায়।
ফুটবল মাঠে উত্তেজনা বিরাজ করে না, হৈচৈ হয় না, বোতল ও বরফ ছুড়ে মারা হয় না। এ রকম ফুটবল অ্যারেনা শুধু এশিয়ায় নয়, ইউরোপ বা কোনো দেশে আছে কি না আমার জানা নেই। জানা নেই অতিরিক্ত উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে হাতাহাতি হয় না। এটি শুধু দেশে নয়, ইউরোপের গ্যালারিতে দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকের আছে। আর তাই দেশে কিংস অ্যারেনাকে অনিরাপদ আখ্যায়িত করে প্রচারণার আগে ভাবার দরকার আছে—এটির ক্ষতিকর প্রভাব কী হতে পারে। এ ধরনের প্রচারণা দেশের ফুটবলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। কিংস অ্যারেনাটি তো এএফসি এবং ফিফার স্বীকৃত ভেন্যু। আন্তর্জাতিক ম্যাচে উত্তেজনা লক্ষণীয় হয়েছে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়। এ ধরনের উত্তেজনা কি বিদেশে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে গিয়ে বাংলাদেশ দল মোকাবেলা করেনি। প্রিমিয়ার লীগের খেলায় তো শুধু কিংসের অ্যারেনায় ‘স্মোক ফ্লেয়ার’ ধোঁয়া দেখা যায়নি। ঢাকার বাইরেও তো এই স্মোক ফ্লেয়ারের ধোঁয়া দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক ম্যাচ চলাকালীন দর্শকদের আচরণের জন্য বাফুফেকে জরিমানা করেছে ফিফা আমরা জানি। এই ঘটনার নিন্দা সবাই করেছেন। এখন যদি কোনো ক্লাব একটি ক্লাবের নিজস্ব ভেন্যুতে খেলতে না চায়—এটির সমাধান তো ফুটবল ফেডারেশনের কাছে আছে। আমরা শুধু চাইছি, এমন কোনো প্রচারণা অ্যারেনাকে ঘিরে করা উচিত নয়, যা দেশের ফুটবলের বৃহত্তর স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে। মাঠের নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার উদ্যোগ বাফুফে অবশ্যই নেবে। এটি শুধু কিংস অ্যারেনা নয়, অন্য ভেন্যুতেও।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া