১৩ জুলাই, ২০১৯ ১১:৩৪

বাদল সাহেবের অভিমান

নাইম আবদুল্লাহ

বাদল সাহেবের অভিমান

প্রতীকী ছবি

বাদল সাহেব সিডনি এয়ারপোর্টের আভ্যন্তরীণ লাউঞ্জে বসে আছেন। চার ঘণ্টা পর তার ফ্লাইট। তিনি স্ত্রী ও ছেলের সাথে রাগারাগি করে একেবারে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। আজ সকালেই স্ত্রীর কাছে জানতে পারেন তার ছেলে একটি অজি মেয়েকে প্রপোজ করে লিভ টুগেদার করছে। তার স্ত্রী বিষয়টা অনেকদিন গোপন রেখেছিল। আজ জেরার মুখে বেরিয়ে পড়েছে।

সাথে সাথেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। সিডনিতে তার এক বন্ধুর ট্রাভেল এজেন্সি আছে। ফোন করে নেক্সট ফ্লাইটে টিকেট করে এয়ারপোর্টে চলে এসেছেন। যদিও ফ্লাইট অনেক পরে তবুও বাসায় থাকার কোন মানে হয় না। বাসা বের হবার আগে স্ত্রীকে বলে এসেছেন ছি ছি ছি!, থাকো তোমার ছেলে আর অজি বৌ নিয়ে। আমি এই সবের মধ্যে নাই।

রাগের মাথায় সাথে করে শুধু একটা ট্রলিতে কয়েকদিনের জামা কাপড় নিয়েছেন। তার ছেলের যখন তিন বছর বয়স তখন সস্ত্রীক সিডনিতে এসেছিলেন। পেশায় তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। গত পঁচিশ বছর চাকরি করবার পর গত বছরের বড়দিনের আগে আগে তার কোম্পানি সিডনি থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। তারপর এই বয়সে আর তেমন সুবিধাজনক চাকরি না পাওয়ায় বাসায় বসেই ছিলেন। অবশ্য কোম্পানি থেকে তিনি বেশ বড় অংকের টাকা পেয়েছেন।

সিডনি এয়ারপোর্টের আভ্যন্তরীণ লাউঞ্জের বামদিকের একটা কফি শপের কফি তার পছন্দ। মাঝে মধ্যে আত্মীয় স্বজন কিংবা বন্ধু বান্ধব বেড়াতে এলে তাদের রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে এলে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে এই কফি শপে অপেক্ষা করেন। আজও সে কফি নিয়ে বসেছেন। কিন্তু স্ত্রী তার পাশে নেই। মনটা খুব খারাপ লাগছে। রাগের মাথায় মোবাইল ফোনও সাথে আনেননি। একবার ভাবলেন, ফোন বুথ থেকে স্ত্রীকে ফোন করলে কেমন হয়। আবার ছেলের ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় নিজেকে ফোন করা থেকে বিরত রাখলেন।

এই সময় তার সামনে দিয়ে অল্পবয়সী একটা মেয়ে একটা বিরাট ট্রলি ভর্তি সুটকেস নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় হাতের পাসপোর্ট আর টিকেট নীচে পড়ে গেলো। বাদল সাহেব একটু এগিয়ে গিয়ে পাসপোর্ট ও টিকেট উঠিয়ে মেয়েটির হাত দিলেন। বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন আছো, মা? তোমার সাথে তো কাউকে দেখছি না।' মেয়েটি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাদল সাহেবের আপাদমস্তক দেখে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, 'চাচা, আমি একা এসেছি।' তারপর বাদল সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। বাদল সাহেব আরেক কাপ কফি নিয়ে চেয়ারে এসে বসলেন। মনে মনে ভাবলেন, 'ভালই হয়েছে মোবাইলটা সাথে না এনে। তা না হলে স্ত্রী ফোন করে বিরক্ত করতো।'

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি ফিরে এসে তার সামনে কিংকর্তব্য বিমুড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। বাদল সাহেব উঠে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, 'মা কিছু বলবে?'

মেয়েটা মাথা নিচু করে হাতের ট্রলির ব্যাগগুলির দিকে তাকিয়ে রইলো। বাদল সাহেবও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

হঠাৎ মেয়েটা কান্না শুরু করে দিলো। বাদল সাহেব তাকে অভয় দিয়ে বললেন, মা, তোমার কোন সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো। তার কথা শুনে মেয়েটার কান্নার আওয়াজ আরও বেড়ে গেলো। বাদল সাহেব মনে মনে ভাবলেন ভাগ্য ভালো। সিডনি এয়ারপোর্ট না হয়ে ঢাকা এয়ারপোর্ট হলে বেইজ্জতের সীমা ছিল না।

বেশ কিছুক্ষণ পর মেয়েটি টিস্যুতে চোখ মুছে মাথা নিচু করে বলল, 'যে বান্ধবী আমাকে নিতে আসবে তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।' এই বলে আবার কান্না শুরু করে দিলো।

বাদল সাহেব বললেন, 'মা কান্না থামাও। এভাবে কাঁদলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না। তোমার বান্ধবীর ফোন নাম্বারটা প্লিজ আমাকে দাও।'

তিনি পাশের ফোন বুথ থেকে তার বান্ধবীকে কয়েকবার ফোন করলেন, কেউ ধরলো না। এভাবে তিনি প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চেষ্টা করলেন। কোন কাজ হল না।

মেয়েটিকে তিনি পাশের চেয়ারে বসালেন। এক বোতল পানি কিনে আনলেন। তারপর বললেন, 'সব কাহিনী খুলে বলো মা।'

সে এক ঢোক পানি খেয়ে বলল, চাচা গত তিন বছর আগে সিডনি প্রবাসী এক ছেলের সাথে বাবা-মা আমার বিয়ে দিয়েছিল। আমার স্বামী সিডনি ফিরে আসার পর মাত্র ছয়মাস যোগাযোগ ছিল। তারপর আর কোন খোঁজ নাই। আমি কোনভাবেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও কিছু বলতে পারছে না।

পরে ফেসবুকে আমার সিনিয়র এক কলেজ বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ হয়। সেও অনেক খুঁজে আমার স্বামীর কোন খবর পায়নি। পরে স্বামীকে খুজতে আসার জন্য আমার এক বড়লোক আত্মীয়কে ধরে সিডনি আসার ভিজিটর ভিসা জোগাড় করি।

বাদল সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন, 'সব কিছুই তো বুঝলাম মা। কিন্তু তোমার বান্ধবি এয়ারপোর্টে তোমাকে নিতে এলো না কেন?'

'চাচা আমার বান্ধবী নয় মাসের প্রেগন্যান্ট। ওর কিছু জটিলতাও দেখা দিয়েছে। আমি যখন ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ওকে ফোন করি তখন আমাকে জানিয়েছিল। হয়তো স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করছে।'

বাদল সাহেব দ্রুত ভাবছেন। তিনি হাতঘড়ি দেখলেন। ফ্লাইটের এখনও দুই ঘণ্টা বাকি। তিনি ট্রাভেল এজেন্ট বন্ধুকে ফোন করে ফ্লাইট বাতিল করলেন।

তারপর মেয়েটার ট্রলিটা নিজ হাতে নিয়ে বললেন, 'আমি তোমার বাদল চাচা। চল, তোমার বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ না হাওয়া পর্যন্ত তুমি আমাদের বাসায় থাকবে।'

মেয়েটি তার নাম স্বপ্না জানালো। ট্যাক্সিতে উঠে স্বপ্না বলল, আচ্ছা, চাচা আপনিও বুঝি কোথাও যাচ্ছিলেন তাই না?

বাদল সাহেব স্বপ্নাকে সব খুলে বললে দুজনেই হেসে উঠলো।

লেখক: সিডনি প্রবাসী ও সাংবাদিক

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর