শুক্রবার, ২০ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
অনুভবের আলোয়

‘খেয়া’ কাব্যের ‘কৃপণ’ কবিতা

মীনাক্ষী সিংহ

‘খেয়া’ কাব্যের ‘কৃপণ’ কবিতা

প্রাক-গীতাঞ্জলি পর্বে ‘খেয়া’ কাব্য রবীন্দ্র ভাবনার এক বিশিষ্ট তত্ত্ববাহী, দুঃখব্রতের অভিজ্ঞান। ব্যক্তিগত জীবনে পরম প্রিয়জনদের মৃত্যুতে বেদনার অভিধাতে কবিচিত্ত যেন পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হয়ে উঠেছে। এ কাব্যেই দেখা গেছে তার রাজাভাবনা যা এক বিশেষ তত্ত্বের বাহক। ‘খেয়া’ কাব্যের ‘আগমন’ কবিতায় এ রাজার প্রথম আবির্ভাব। ঝড়ের রাতে দুঃখের প্রহরে আমাদের জীবনে রাজার আগমন ঘটে। তিনি বিশ্বজীবনাশ্রিত মঙ্গল চৈতন্যস্বরূপ। দুঃখের তিমিরে তার আবির্ভাবেই জ্বলে ওঠে মঙ্গল আলোক। তিনি রাজা, প্রভু, পরাণ প্রিয়, সখা।

‘খেয়া’ কাব্যের ‘কৃপণ’ কবিতায় সেই রাজারই দেখা মিলেছে।  কিন্তু ইনি ঝড়ের রাতে হঠাৎ আসা আঁধার ঘরের রাজা নন; ইনি জয়রথের আরোহী। বিচিত্র শোভা ও বিচিত্র সাজে সজ্জিত এ রাজাধিরাজ এসেছেন স্বয়ং ভক্তের কাছে।

রবীন্দ্রনাথ একটি সংক্ষিপ্ত আখ্যানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট তত্ত্ব। তিনি যেন একদিন গ্রামের পথে পথে ভিক্ষাব্রত নিয়ে বের হয়েছেন। সেই পথে ঈশ্বর রাজাধিরাজ স্বর্ণরথে পরিক্রমারত।

‘আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলাম/গ্রামের পথে পথে

তুমি তখন চলেছিলে/তোমার স্বর্ণরথে’

কবির মনে এই প্রত্যাশা আজ তার ভিক্ষার ঝুলি ভরে যাবে রাজার দাক্ষিণ্যে। কিন্তু তিনি পরম বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন যে স্বয়ং রাজা তার রথ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছেন কবির সামনে। শুধু তাই নয় রাজাধিরাজ স্বয়ং তার কাছে ভিক্ষাপ্রার্থী। ‘আমায় কিছু দাও গো বলে/ বাড়িয়ে দিলে হাত’। আমরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থী হয়েই যাই, কিন্তু কবি অভিভূত বিস্ময়ে দেখলেন বিপরীত দৃশ্য। স্বয়ং ঈশ্বর এসেছেন তার কাছে ভিক্ষা চাইতে। ভগবানের সঙ্গে ভক্তের এই সমতার কথা রবীন্দ্রনাথ বললেন। ঈশ্বর-রাজাধিরাজ মানুষের কাছে আসেন বন্ধুর মতো। দেবতাও প্রিয় রবীন্দ্রমনকে একাকার হয়ে গেছেন। গীতাঞ্জলিতে দেখি— ‘তব সিংহাসনের আসন হতে/এলে তুমি নেমে/ মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে/ দাঁড়ালে নাথ থেমে’। আমরাই যে কেবল ঈশ্বরের কাছে ভিক্ষার্থী-তাই নয়, কবি দেখালেন ঈশ্বরও মানবের কাছে ভিক্ষার্থী। তিনি আমাদের কাছে প্রেমভক্তি ভালোবাসার প্রত্যাশী। এই বোধেই আছে সীমা অসীম তত্ত্ব।

কিন্তু কবিতাটির নামকরণে আছে আর একটি দ্যোতনা। রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছেন যে আমরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থী হয়ে যাই; কিন্তু নিজেদের সবকিছু উজাড় করে দিতে আমাদের কৃপণতা। তাই রাজভিখারী যখন ভিক্ষা চাইলেন তখন ঝুলি থেকে একটি মাত্র ছোট্ট কণা তাকে দিলাম। দিনশেষে ভিক্ষার ঝুলি উজাড় করে দেখি সেই ছোট্ট কণা সোনার উপহার হয়ে ফিরে এসেছে। তখন চোখের জলে ভেসে গিয়ে কবি কাঁদছেন-কেন, রাজভিখারীকে তার সর্বস্ব দেননি, তা তো অক্ষয় ধন হয়ে ফিরে আসতো তার ভাণ্ডারে। আসলে ঈশ্বরকে আমরা সর্বস্ব দিতে পারি না, আমাদের কৃপণ স্বভাব আমাদের বাধা দেয়। তার গানে রবীন্দ্রনাথ এই ভাবনাকে বারবার রূপ দিয়েছেন।

— ‘আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারিনি তোমারে নাথ’

যেদিন সব সমর্পণ করে তাকে দিতে পারবো সেদিনই আমাদের ঘটবে পরম প্রাপ্তি। আমাদের জাগতিক সব কিছুকে যেদিন রাজাধিরাজের চরণে নিবেদন করতে পারবো সেদিন তাকে পাওয়া পূর্ণ হবে।

‘তাই তো প্রভুর রাজার রাজা হয়ে

তবু আমার হৃদয় লাগি

ফিরছ কত মনোহরণ বেশে

প্রভু, নিত্য আছ জাগি।’

প্রভু আমাদের দুয়ারে এসেছেন, আমাদের হৃদয়ের নৈবেদ্যর জন্য; আমরা যেন কৃপণ হয়ে তাকে ফিরিয়ে না দিই। কারণ তাকে যা দেব তা আবার পূর্ণ স্বরূপে আমাদের কাছে ফিরে আসবে, সেদিনই তাকে জীবনে পাওয়া পূর্ণ হবে।

‘কৃপণ’ নামকরণের মধ্যে এই ভাবসত্য রূপায়িত যে ঈশ্বরকে নিবেদনের ক্ষেত্রে আমরা সর্বস্ব দিতে পারি না, অনেক হিসাব করে তবেই তাকে অর্পণ করি। কিন্তু এ আমাদের ভ্রান্তি-কারণ তাকে যদি সর্বস্ব উজাড় করে দিতে পারি, তাহলেই আমরা পূর্ণ হব। আমাদের সম্পদ অক্ষয় হবে।

সেই রাজভিখারী তার অকৃপণ দানে আমাদের পূর্ণ করেন। তার গানে রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন—

‘তিনি যখন ভিক্ষা নিতে আসেন আমার দ্বারে

বন্ধ তালা ভেঙে দেখি, আপন মাঝে গোপন রতন ভার

হারায় না সে আর’

রবীন্দ্রনাথ ‘খেয়া’ পর্বে তার জীবনদেবতার সঙ্গে যে বন্ধনে আবদ্ধ, সেখানে উভয়ের মধ্যে সমব্যথী বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমরা জানি ঈশ্বরের কাছে আমরাই কেবল প্রার্থী। রবীন্দ্রনাথ দেখালেন—ঈশ্বরও আমাদের কাছে প্রার্থী।

‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর

তুমি তাই এসেছ নীচে

আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর

তোমার প্রেম হতো যে মিছে’

‘কৃপণ’ কবিতায় আমাদের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে কবি দেখালেন ঈশ্বরকে দেওয়ার বেলায় কৃপণতা চলবে না, আমাদের সর্বস্ব উজাড় করে তাকে দিতে হবে, কারণ তিনি তা পূর্ণতর করে ভরে দেবেন। তাই তিনি যখন আমাদের কাছে প্রেমের ভিখারী, তখন আমরা যেন অঙ্গীকার করি—

‘আমার জগতের সব তোমারে দেব

দিয়ে তোমায় নেব-বাসনা’

আমাদের কৃপণ স্বভাবের  দায় ঘুচিয়ে ঈশ্বরকে যেদিন

যথাসর্বস্ব অর্পণ করতে পারব, সেদিনই আমাদের পরম

পাওয়া হবে পরিপূর্ণ।

সর্বশেষ খবর