শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বাঙালির ঈদ উৎসব

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বাঙালির ঈদ উৎসব

ছবি : সংগৃহীত

মুসলমানদের প্রধান উৎসব দুটি এবং দুটিই ঈদ। দুটিতেই আনন্দ, তবে এই আনন্দের উদযাপন ও প্রকাশ ভিন্ন।

দীর্ঘদিনের উদযাপনে রমজান মাসের শেষে যে ঈদ আসে, সেটিকেই আনন্দ প্রকাশের বড় একটি উপলক্ষ হিসেবে আমরা বেছে নিয়েছি। এক মাস রোজা রেখে ঈদ পালনটা যেন একটি পুরস্কার হিসেবেই দেখা হয়। অন্য ঈদটি ঈদুল আজহা, আসে এই ঈদের আড়াই মাস পর।

এক সময়, যখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না, সিংহভাগ মানুষকে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হতো, ঈদুল আজহাতে পরিবারের সবার জন্য আরেক দফা কাপড়-জামা-জুতা কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। তাছাড়া যারা কোরবানি দিতে পারতেন, তারা এদিকেই মনোনিবেশ করতেন। ফলে ঈদুল আজহাতে রোজার ঈদের মতো উদযাপন হতো না।

এখন বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা ফিরেছে। এখন একজন মুদি দোকানদার অথবা সবজি বিক্রেতাও ঈদে সন্তানদের কাপড়-জামা কিনে দিতে পারেন। তারপরও সেই দেওয়াটা রোজার ঈদেই বেশি হয়। এর একটি কারণ হয়তো এই যে, ঈদুল আজহার জন্য মানুষ প্রস্তুত হতে সময় কম পায়। ছুটি-ছাটাও দ্রুত ফুরিয়ে যায়। রোজার ঈদের প্রস্তুতি চলে এক মাসজুড়ে, সারা রমজানেই কেনাকাটা চলে।

আমরা যখন স্কুলে পড়ি, সেই পঞ্চাশ-ষাট দশকে, রমজানের কেনাকাটা ছিল সীমিত। আমাদের শহরটাতে, সিলেটে, কেনাকাটা যেটুকু হতো, বন্দরবাজার আর জিন্দাবাজারেই হতো, কিন্তু মহিলারা তাতে শামিল হতেন না। তাদের শাড়ি-জুতা পুরুষরাই কিনতেন। আমরা প্রতি ঈদে নতুন জামা পেতাম না, না পেলেও কেউ মন খারাপ করত না-আগের বছরের শার্টপ্যান্ট পরেই ঘুরে বেড়াতাম। আমার দু-এক বন্ধু ছিল, যাদের বাবা-চাচারা ইংল্যান্ডে থাকতেন।

তারা ভালো শার্ট-জুতা পাঠালে সেগুলো পরতে তাদের কুণ্ঠা হতো, যেহেতু কোনো কোনো বন্ধু হয়তো ঈদে কোনো উপহার পায়নি। ঈদের দিনে যা হতো, পরিবারের সব পুরুষ যেতেন নামাজে এবং নামাজ থেকে ফেরার পর বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো, সুখাদ্য খাওয়া, আর খোলা মাঠে আমাদের খেলাধুলায় মেতে ওঠা ছিল একটা প্রতিষ্ঠিত চর্চা। এ জন্য ঈদের আনন্দটা হতো ভোজনের, পাড়া-ভ্রমণের আর পড়াশোনা ভুলে যাওয়ার।

প্রতিটি বাড়িতে ঈদের রান্না হতো ব্যাপক আয়োজনে। আমাদের বাড়িতেও এই আয়োজন চলত দুদিন ধরে। আমার মা রান্নাবান্না করতেন প্রয়োজন হলে, বাহুল্য পছন্দ করতেন না এবং সামান্য আয়োজনে অসামান্য রান্না শেষ করতেন। কিন্তু ঈদের রান্নাতে তিনি ছিলেন অকৃপণ। ঈদের খাদ্যে ভাগ বসাতো বন্ধুরা, পাড়া প্রতিবেশীরা। এটি শুধু আমাদের নয়, সব বাড়িরই চর্চা ছিল।

রোজার দিনে ইফতারি বাড়িতেই তৈরি হতো। বাইরে থেকে ইফতারি কেনা হতো কম বাড়িতে; বাইরে ইফতারি তৈরিও হতো যৎসামান্য। আমার ছেলেবেলা এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ইফতারি যেত। ইফতারির আয়োজনও হতো সাদামাটা। ইফতারির সময়টা ছিল সবার। বাড়ির লোক, খুব প্রয়োজন না হলে, ইফতারে অনুপস্থিত থাকতেন না।

ফকির-মিসকিনদের জন্য ইফতারির একটা অংশ তোলা থাকত, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে, যাদের সামর্থ্য ছিল তাদের।

২.

প্রতিটি উৎসবের মতো যুগের প্রকাশ ধারণ করে ঈদ উৎসবও অনেকটা পাল্টেছে, যদিও এর মূল সুর পাল্টায়নি, পাল্টানোর কথাও নয়। মূল সুরটা সেই আনন্দের, নিজের মতো করে উদযাপনের।

যা পাল্টেছে তাতে যুগের হাওয়া প্রবলভাবেই লেগেছে। আমাদের সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, এখন ইফতারি আর কেনাকাটাই মিডিয়াকে এবং মানুষকে ব্যস্ত রাখে সারা রমজান। অনেকের কাছে শুনেছি, রমজানের আগে থেকেই, প্রধানত ভিড় এড়াতে, ঈদ উপহার কেনা শেষ হয়। অনেকে কলকাতা-ব্যাংককও দৌড়ান। তৃতীয় একটা আয়োজন যা নতুন যুক্ত হয়েছে, তা হচ্ছে ঈদে বেড়াতে যাওয়া। এই বেড়াতে যাওয়া বাড়ি ফেরা নয়-বাড়ি ফেরাটা আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু ঈদে মধ্যবিত্তের কক্সবাজার-কুয়াকাটা যাওয়া, উচ্চ-মধ্যবিত্তের এবং উচ্চবিত্তের দেশের বাইরে যাওয়া যেন একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল রমজান মাসে যেরকম আড়ম্বরে নামিদামি রেস্টুরেন্টগুলোতে সেহরি খাওয়া হয়, সেরকম সারা রমজান ধরে ইফতার পার্টিও চলে। এগুলোও মানুষের ঈদ-আনন্দের অগ্রিম জোগান, এসব আগে ছিল না।

এই যে সারা রমজান মাসে প্রতিদিন দুটো-তিনটা বাজলেই সব টিভি চ্যানেলে ইফতারি কেনাবেচার ছবি দেখানো শুরু হয়, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে করা প্রতিবেদনে ইফতারিকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়, এ হচ্ছে দৃশ্যমাধ্যমের, প্রধানত টেলিভিশন এবং অতি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবদান। ঈদের কেনাকাটাও তাই। মানুষ যত তা পর্দায় দেখছে, তত আকৃষ্ট হচ্ছে, উৎসাহিত হচ্ছে, প্রলোভিত হচ্ছে তাতে অংশ নিতে। এটি শুধু ঈদের ক্ষেত্রেই হচ্ছে না, হচ্ছে অন্যান্য ধর্মের উৎসবের ক্ষেত্রে, অন্যত্রও। পশ্চিমে বড়দিন বহুদিন থেকেই এর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য হারিয়েছে। বড়দিন মানেই কেনাকাটা। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই দৃশ্যমাধ্যম ব্যস্ত হয়ে পড়ে এই কেনাকাটার প্রচারে। কলকাতার দুর্গাপূজার মৌসুমেও তাই। পণ্যসংস্কৃতি যে ‘চমকের সমাজ’ তৈরি করেছে, যাতে পুষ্টি জোগাচ্ছে দৃশ্যমাধ্যম, তা সব কিছুর একটা পণ্যমূল্য নির্দিষ্ট করে দেয়। উৎসব-পার্বণের শেষে হাসতে হাসতে ব্যাংকে যান ব্যবসায়ীরা। আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা রমজান আসার আগে থেকেই নিত্যপণ্যের মজুদ বাড়ান এবং চাল-ডাল-রান্নার তেল ও পিয়াজ-চিনির দাম আকাশমুখী করে দেন। অনেক মানুষের ঈদ-আনন্দ তাতে অনেকটাই কমে। কিন্তু তাতে এ ব্যবসায়ীদের কোনো সমস্যা হয় না। তাদের বিবেকে টান পড়ে না।

পশ্চিমে অবশ্য বড়দিনের কেনাকাটায় উল্টোটি হয়। অনেক ছাড়ে পণ্য বিক্রি হয়। আমি পাঁচ বছর কানাডায় ছিলাম। আমার বাড়িওয়ালা আমাকে বলতেন, বড়দিনের বাজার থেকে তিনি মাস দুয়েকের প্রয়োজনীয় সামগ্রী অল্প দামে কিনে রাখেন। আমাদের দেশে যদি এই সংস্কৃতিটা চালু হতো!

দৃশ্যমাধ্যমের অনেকগুলো কাজের একটি হচ্ছে চিত্রকল্পের পুনরাবৃত্তি এবং চিত্রের পেছনের কল্পনারও। ইংরেজিতে একে বলে Simulacrum. পুনরাবৃত্ত হতে হতে কোনটা আসল, কোনটা নকল, তা বোঝাটা কঠিন হয়ে পড়ে। বারবার একই জিনিস দেখতে দেখতে মানুষও ভাবে, নকলটাই বোধহয় আসল। প্রতি বছর কেনাকাটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাতে দেখাতে টিভি চ্যানেলগুলো মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, কেনাকাটাটাই আসল। মুদ্রিত খবরের কাগজ সেটি পারত না, পারেও না।

দৃশ্যমাধ্যম উদ্ধৃতির ব্যবহারে পারঙ্গম। কেউ একজন পাখি-পোশাক পরে সিনেমায়-টিভি সিরিয়ালে নেমেছে। তারপর অন্যরা তা উদ্ধৃত করতে শুরু করেছে। বাজারে পাখি-পোশাক এসেছে উদ্ধৃতির প্রতীক হয়ে। সেই পোশাক না পেলে জীবন ব্যর্থ বলে ভাবতে শুরু করেছে অনেক মেয়ে। উদ্ধৃতি আড়াল করে ফেলেছে মৌলিকতাকে।

বাজার তার স্বার্থে চমক আর চিত্রকল্পের পুনরাবৃত্তি এবং উদ্ধৃতিকে বাস্তবের মোড়কে ছেড়ে দিয়েছে। বিপত্তিটা সেখানেই।

এ বছরও আমি দেখলাম ঈদ আনন্দের পাশাপাশি কিছু যে অপরিহার্যতা আছে, তার প্রতি মিডিয়ার দৃষ্টি সামান্যই। গরিবের জন্য যা কিছু কর্তব্য-যেমন জাকাত দেওয়া, তাদের ইফতারির এবং ঈদ সামগ্রীর বন্দোবস্ত করা, সেগুলো বলা হয় পাদটীকার মতো। আমি একটা ইফতার পার্টিতে গিয়ে দেখেছি, খাদ্যের কত অপচয়। যারা ইফতারি খাচ্ছেন, তারা কিনে খেতে সক্ষম, দশজনকে খাওয়াতেও সক্ষম। ওই ইফতারি একটা এতিমখানায় পাঠিয়ে দিলে, সামান্য আয়োজনে আমন্ত্রিতদের ইফতারি সারা হলে, তৃপ্তি পেতেন অনেক মানুষ। ইফতার পার্টিটাও মিডিয়ার কল্যাণে এখন পুনরাবৃত্ত একটি রূপকল্প। রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে একভাবে দেখছে, নানা বণিক সমিতি ও সংগঠন দেখছে অন্যভাবে। কিন্তু এখানেও তারাই আমন্ত্রিত, যাদের কিনে খাওয়ার (এবং সুবিধাবঞ্চিতদের খাওয়ানোর) সক্ষমতা প্রশ্নাতীত।

৩.

এসব কথা না হয় থাক, আমাকে বলা হয়েছে ঈদ উৎসব নিয়ে লিখতে। উৎসবের আনন্দটা কোনো কিছু দিয়ে মাটি করা ঠিক না। আমি বরং শিশুদের ঈদ উৎসবের কথা বলি। তাতে আলোচনাটি ঈদ আনন্দকে ধরে রাখতে পারে।

শিশুদের সম্বন্ধেও বলা যায়, শৈশব কোনো যুগ-নির্দিষ্ট নয়। একশ’ বছর আগে শিশুরা যেরকম আনন্দ করত, যা কিছুতে আনন্দ পেত, এখনো পায়। অনেক আগে আম-আঁটির ভেঁপু বাজিয়ে শিশুরা আনন্দ করত, এক সময় টিনের বাঁশি এলো, এরপর ভুভুজেলাও এলো কিছুদিনের জন্য। বাঁশির চেহারা বদলেছে; এর দেওয়া আনন্দ বদলায়নি। চীনের বাচ্চারা একরকম ঘুড়ি উড়িয়েছে, আপনারা আরেক রকম, কিন্তু আনন্দটা সমান। ঈদের উৎসবটাও শিশুদের জন্য অবিকল থেকে গেছে। স্কুলে পড়ার সময় বাবার পেছনে লাইন বেঁধে আমরা তিন-চার ভাই ঈদের নামাজে গেছি। তাতে মনে হতো দিনটা খুব ছন্দে শুরু হলো। গত ঈদে দেখি, এক মোটরসাইকেলে তিন ছেলেকে সামনে-পেছনে বসিয়ে এক বাবা যাচ্ছেন ঈদগাহের দিকে। পঞ্চাশ বছর পর ঢাকাতে হয়তো পাতাল রেলে বাবারা যাবেন ছেলেদের নিয়ে ঈদের নামাজে। যাত্রাটা ভিন্ন, আনন্দটা সমান। এ জন্য ঈদ উৎসবটা সবচেয়ে রঙিন হয়, যদি শিশুরা তাতে অংশ নেয়। এখন প্রতিটি শিশুই ঈদে নতুন জামা গায়ে পরতে চায়। জুতা চায়, আরও অনেক কিছু চায়। যদি প্রত্যেক শিশুকে সেসব জোগান দেওয়ার মতো সক্ষম, সংবেদনশীল, বিবেকবান সমাজ আমরা তৈরি করতে পারি, তাহলে মিডিয়ার চমকের জগৎ সত্ত্বেও দারুণ এক আনন্দময় উৎসবে পরিণত করতে পারব ঈদকে।

শিশুদের কথা বলতে গিয়ে আমার চোখে ভাসছে খুন হয়ে যাওয়া এক বাবার দুই কন্যার মুখ, গুম হয়ে যাওয়া অনেক মানুষের সন্তানদের মুখ। এদের ঈদটা কেন আনন্দের হবে না, কোনো দিনই হয়তো হবে না, সে প্রশ্ন আমরা যতই করি, উত্তর মিলবে না।

৪.

পাঠকদের জন্য ঈদের শুভেচ্ছা রইল। ঈদ তো আর প্রতিদিন আসে না; ঈদটা বিশেষ একটা দিন। এই দিনে আমরা কি নিজেদের দিকে একবার ফিরে তাকাতে পারি না, একটা সংকল্প গ্রহণ করতে পারি না, আগামী প্রতিটা ঈদ যেন আসে সবার আনন্দ নিশ্চিত করতে? বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়েছে, আরও এগোবে, কিন্তু এই এগোনোর পথে সবার হাত ধরে সবাইকে এগোতে হবে, কাউকে পথের পাশে ছিটকে পড়ে যেতে দেওয়া যাবে না।

এবং শিশুদের হাত আমাদের ধরতে হবে পরম মমতা ও ভালোবাসায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর