শিরোনাম
শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

মিল্লাতে ইবরাহিমের (আ.) ঐক্য

কালাম আজাদ

মিল্লাতে ইবরাহিমের (আ.) ঐক্য

পবিত্র কাবাগৃহ সংলগ্ন হজরত ইবরাহিম (আ.) এর পদচিহ্ন মাকামে ইবরাহিম

আরব ভূখন্ডে উদ্ভাবিত তিনটি ধর্মীয় মতবাদ ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের কাছে হজরত ইবরাহিম (আ.) পরম শ্রদ্ধেয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত। আমরা প্রতি বছর যে ঈদুল আজহা পালন করছি তা মূলত হজরত ইবরাহিম (আ.)-এরই সুন্নত। হজ পালনের সঙ্গেও জড়িত হজরত ইবরাহিমের পবিত্র স্মৃতি। তাঁর জন্ম মানবসভ্যতার পাদপীঠ ইরাকের উর নগরীতে। তার বাবা ছিলেন পৌত্তলিক। শুধু মূর্তি পূজারিই নন, মূর্তি বানানোর শিল্পী ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ইবরাহিম (আ.) উপলব্ধি করেন, কোনো মূর্তিকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। মূর্তির কোনো ক্ষমতা নেই। তিনি তা প্রমাণও করেন। হজরত ইবরাহিম একেশ্বরবাদের কথা প্রচার করেন। তিনি শিক্ষা দেন আল্লাহ এক তার কোনো শরিক নেই। এই শিক্ষায় ক্ষেপে ওঠে অসত্য, অসুন্দর আর অকল্যাণের অনুসারীরা।

হজরত ইবরাহিমের একেশ্বরবাদের কথা রাজা নমরুদের কানে যায়। অহংকারী এই রাজা নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করতেন। তিনি হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করেন। এ নিয়ে ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে রয়েছে মনোগ্রাহী কাহিনি। বলা হয়, নমরুদ ইবরাহিমকে অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বলে, তোমার আল্লাহর যদি কোনো ক্ষমতা থাকে তবে এ অগ্নিকা- থেকে রক্ষা করুক। হজরত ইবরাহিম (আ.) বাধ্য হয়ে এ শাস্তি মেনে নেন। যথাসময়ে সাজানো হয় অগ্নিকু-। উৎসবী আমেজে মেতে ওঠে রাজা নমরুদের অনুসারীরা। ঢোল-বাদ্য আর নাচের তালে তালে হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে নিক্ষেপ করা হয় অগ্নিকু-ে। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার। মুহূর্তে অগ্নিকু- পরিণত হয় ফুল বাগানে। হজরত ইবরাহিম (আ.) রক্ষা পান নিশ্চিত মৃত্যু থেকে। প্রমাণিত হয় ইবরাহিম (আ.)-এর আল্লাহ সত্যিকার অর্থেই সর্বশক্তিমান। অদৃশ্য ও নিরাকার এই আল্লাহ ইচ্ছা করলেই অগ্নিকু-কেও ফুল বাগানে পরিণত করতে পারেন।

হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে কেন্দ্র করে তাওরাত, ইঞ্জিল ও পবিত্র কোরআনে অনেক আয়াত রয়েছে। মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে অনেক ধর্মীয় কাহিনি। বলা হয়, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। বৃদ্ধ বয়সে তিনি পুত্র সন্তানের জনক হন। স্ত্রী হাজেরার গর্ভে জন্ম নেন হজরত ইসমাইল (আ.)। ছোটবেলা থেকেই যিনি ছিলেন পিতার মতোই আল্লাহপ্রেমী। ইমানের বলে বলীয়ান। হজরত ইবরাহিম (আ.) এক দিন স্বপ্ন দেখলেন আল্লাহ তাকে কোরবানি দেওয়ার আহ্বান করেছেন। সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করার নির্দেশ পেলেন তিনি। এ স্বপ্ন দেখার পর হজরত ইবরাহিম (আ.) সকালে উঠেই হালাল পশু কোরবানি দিলেন। কিন্তু সে দিন রাতেই আবার দেখলেন একই স্বপ্ন। এ স্বপ্ন দেখার পর সকালে উঠেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আবারও পশু কোরবানি দিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। কিন্তু তৃতীয় রাতেও, একই স্বপ্ন দেখার পর নবীর বোধোদয় হলো। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তো পুত্র ইসমাইল। আল্লাহ তো প্রিয় বস্তুকে তার রাহে কোরবানির নির্দেশ দিয়েছেন।

হজরত ইবরাহিম (আ.) সিদ্ধান্ত নিলেন যত কষ্টকর হোক আল্লাহর নির্দেশই পালন করবেন। তারপর সকালে উঠেই পুত্রকে নিয়ে গেলেন এক বিরাট প্রান্তে। পথিমধ্যে শয়তান ইসমাইলকে জানায় তাকে আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হজরত ইসমাইল (আ.) শয়তানকে ভর্ৎসনা করে বলেন, আল্লাহর রাহে কোরবানি হতে পারলে সে তো আমার সৌভাগ্য। হজরত ইবরাহিম (আ.) যথাস্থানে এসে প্রিয় পুত্রকে তার স্বপ্নের কথা খুলে বলেন। হজরত ইসমাইল (আ.) দ্বিধাহীনভাবে বাবাকে বলেন, আল্লাহর রাহে কোরবানি হতে আমি প্রস্তুত। তাঁর চোখে কাপড় বেঁধে কোরবানি করেন প্রিয় পুত্রকে। কোরবানি শেষে চোখ খুলতেই তিনি দেখতে পান সামনে একটি দুম্বা জবাই হয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)। আল্লাহ হজরত ইবরাহিমের ইমানি পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হন।

আল্লাহর প্রিয় নবী হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতির স্মরণেই মুসলমানরা ঈদুল আজহায় হালাল পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। অবস্থাপন্ন মুসলমানরা এ সময়ে পবিত্র কাবাগৃহে পালন করেন হজব্রত। মুসলমানদের কেবলা হিসেবে পরিচিত কাবাগৃহ নির্মাণের সঙ্গেও হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাইলের স্মৃতি জড়িত। বিপথগামী মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান জানান হজরত ইবরাহিম (আ.)। তার আহ্বানে সাড়া দিল ইহুদিরা। আল্লাহকে তারা মেনে নিল ত্রাণকর্তা হিসেবে। হজরত ইবরাহিমের শিক্ষায় নিজেদের আলোকিত করল তারা। ঐক্যবদ্ধ হলো আল্লাহর প্রেরিত পুরুষের পেছনে। এ ঐক্য ইহুদিদের ভাগ্য ফেরাল। যারা ছিল অভিশপ্ত জাতি তারা পেল নিজস্ব ভূখ-। গঠিত হলো নতুন দেশ। নাম যার কানান। যে দেশটি এখন ফিলিস্তিন নামে পরিচিত। ইবরাহিম (আ.) মানুষকে শিক্ষা দেন আল্লাহ এক। তার কোনো চেহারা নেই। যার চেহারাই নেই তার কোনো মূর্তি হতে পারে না। কিন্তু ইবরাহিম (আ.)-এর এ শিক্ষাকে ইহুদিরা ধরে রাখতে পারেনি। তারা ভুলে গেল আল্লাহর কথা। ভুলে গেল ইবরাহিম (আ.)-এর শিক্ষা। মূর্তিপূজা শুরু করল তারা। যে উপাসনাগারে এক দিন কোনো মূর্তির ঠাঁই ছিল না; সেখানে আবির্ভূত হলো অনেক মূর্তি। ঈশ্বর ভেবে তাদের পূজা করা হতো। ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক অনাচারে। শুরু হলো বিভেদ-হানাহানি। ফলে নেমে এলো আল্লাহর অভিশাপ। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রচেষ্টায় ইহুদিরা আত্মপ্রকাশ করেছিল স্বাধীন জাতি হিসেবে। সে স্বাধীনতা বিসর্জন দিল তারা। ইহুদিরা পরিণত হয় উদ্বাস্তু জাতিতে। নিজস্ব ভূখ- থেকে তারা বিতাড়িত হয়। ঠাঁই নেয় মিসরে। দাসত্বের জীবনবরণ করতে বাধ্য হয় তারা। এ অবস্থায় আল্লাহর কৃপা হলো। তিনি হজরত মুসা (আ.)-কে পাঠালেন ইহুদিদের কাছে। অভিশপ্ত ইহুদিদের মুক্তির পথ দেখালেন তিনি। প্রচার করলেন মহান আল্লাহর বাণী।

লেখাটির শুরুতে ঈদুল আজহার কথা বলেছি। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত হিসেবে মুসলমানরা যে এই উৎসব পালন করে সে কথাও আগেই বলেছি। হজরত ইবরাহিম (আ.) শুধু মুসলমান নন, পৃথিবীর অন্য দুটি প্রধান ধর্মাবলম্বী খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছেও সমানভাবে সমাদৃত। অশেষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তারাও স্মরণ করেন এই মহাপুরুষের নাম। বিশ্বের তিনটি প্রধান ধর্মীয় মতবাদ ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের অনুসারীরা আজ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত। তাদের এই সংঘাত বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ তিন ধর্মের প্রবর্তকরা মানুষে মানুষে শান্তি ও সৌহার্দ্যরে কথা প্রচার করলেও তাদের অনুসারীদের মধ্যে দানা বেঁধে উঠেছে গভীর অবিশ্বাস। এ অবিশ্বাসই ১১ সেপ্টেম্বরের মতো মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে। মানুষ অনাকাক্সিক্ষত সংঘাতে লিপ্ত তখন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি বিশ্বের তিনটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধাবোধ ঐক্যের সূত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। তাদের মধ্যকার সংঘাতের গ্রন্থিমোচনে সহায়ক হতে পারে।

বিশ্বাসীদের আদি পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে ঐক্যের পরিবেশ। হিংসা, হানাহানি ও অশান্তির পথ থেকে সরে আসার জন্য তাঁর সন্তানদের ঐক্য মানব জাতিকে নতুন পথ দেখাতে পারে। যে পথ শান্তি ও সহাবস্থানের পথ। মানুষে মানুষে ভালোবাসা ও মৈত্রীর পথ। এ পথই আজ মানব জাতিকে নিশ্চিত ধ্বংস থেকে বাঁচাতে পারে।

সর্বশেষ খবর