শুক্রবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ত্রিমুখ

মোস্তফা মামুন

ত্রিমুখ

তিনজনের প্রত্যেকেই মারা যেতে পারত। গাড়িটা এমনভাবে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল যে সামনের সিটের ওরা মনে করেছিল এই শেষ। কীভাবে যে বেঁচে থাকল, কীভাবে যে বের হল সে এক বিস্ময়। গাড়িও সামনের বাম্পারে সামান্য ধাক্কা খেয়েই সামলে নিয়েছে। 

ওখানে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হল। একটা হাসপাতালেও নেয়া হয়েছিল। সেখানে কারো কারো অবস্থা এত খারাপ যে ইমার্জেন্সির ডাক্তার ওদেরকে দেখে বললেন, ‘চলে যান। চলে যান। সিট অকুপাই করবেন না।’

ওরা চলল।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছে তিন বন্ধু। তিনজনের তিন জায়গায় তিনটা কাজ। শেষ করে ১২টায় আবার ফিরতি পথ। ফরিদ বলছিল, বাধা পড়ে গেছে যখন তখন আজ হোটেলে একটু বিশ্রাম নেই। বাসায় জানাই। কাল বরং কাজ শেষ করে...

শাহিন তীব্র প্রতিবাদ করে বলে, ‘না, না। বাসায় জানানো যাবে না। হুলুস্থূল কান্ড হয়ে যাবে।’

আশরাফও একমত। বাসায় জানানো মানে শুধু শুধু টেনশন। তার চেয়ে নির্ধারিত সূচিতে থাকা ভালো।

ঢাকায় আসলে একটা চেনা হোটেলে ওরা ব্যাগ-ট্যাগ রেখে একটু বিশ্রাম নেয়। রাতে আবার মিলিত হয় কাজ শেষে। থাকার হলে রাত কাটায়। নইলে রাতের আবার ফেরার পথ।

দুশ্চিন্তা ছিল ফরিদের গাড়িটা নিয়ে। খুব ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও অ্যাক্সিডেন্টের গাড়ি নিয়ে ফের রাতে রওনা হওয়া যাবে কিনা তাই নিয়ে প্রশ্ন ছিল। গ্যারেজ থেকে জানানো হল, যাবে। আপাতত জরুরি মেরামতটা ওরা করে দেবে। পরে সুবিধামত সময়ে ডেন্টিং করিয়ে নিলেই আবার ঝকঝকে নতুন গাড়ি।

আশরাফের কাজটা বিদেশি এক দল বায়ারের সঙ্গে। চট্টগ্রামে ওর ফ্যাক্টরি, সে ঢাকার রপ্তানিকারককে মাল সাপ্লাই দেয়। সে-ই বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এভাবেই চলছিল এতদিন। গত সপ্তাহে হঠাৎ করে চাইনিজ কোম্পানির একজন বিচিত্র ইংরেজিতে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে বলে, ‘আচরাফ স্পিকিং?’

‘ইয়েস’

‘মি চুং হোয়াং, নিদ তু মিত উ’

আশরাফ ব্যাপারটা বোঝে। ব্যবসায়ী মাথা চালু হয়। বুঝে চীনারা আর ঢাকার ডিস্ট্রিবিউটরকে বাদ দিয়ে ওর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে চায়। সম্ভবত এক্সপোর্টারের সঙ্গে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। দরকষাকষি বেশি করছে সে।

চু হোয়াং এসেছে গতকাল। সঙ্গে আরও দুজন লোক। ওরা ওদের নাম বলল। তবে চীনাদের চেহারা যেমন নামও তেমন, সব কাছাকাছি। ং ছাড়া আর কিছু মনে রাখা যায় না সাধারণত।

চু হোয়াং লোকটার চেহারার মধ্যে বেশ একটা তেলতেলে ভাব। প্রতি কথায় ‘মাই দিয়ার ফ্রেন্ড’ এমনভাবে বলছে যেন আশরাফের দেখা না পেয়ে ওর জীবন অন্ধকার হয়ে ছিল। এখন আলো আর আলো।

বাকি দুজন অবশ্য থ মেরে বসে। পরে জানা গেল, ওরা ইংরেজি এক বর্ণও বুঝে না। ভাষা না জানলে মানুষ আর প্রাণীতে পার্থক্য থাকে না বিশেষ।

যাই হোক, চু হোয়াং এবার প্রসঙ্গে আসে, ‘শোনো, তোমার সঙ্গে শরাফতের কত দিনের চেনা?’

‘বহু দিনের।’

‘উফ..আমি ভাবতেই পারি না, এতদিনের চেনা মানুষকে কেউ এমন ঠকাতে পারে। যাই হোক, ঠকাঠকির দিন শেষ। এখন থেকে সরাসরি তোমার কাছ থেকে জিনিস নেব আমরা। আমরা জেনেছি, তুমি পেতে মাত্র দুই পার্সেন্ট। আর ও নিত, এইট পার্সেন্ট। এখন থেকে তোমার জন্য সেভেন পার্সেন্ট।’

আশরাফ স্তম্ভিত হয়ে যায়। দুই পার্সেন্টেই বছরে ওর আয় কয়েক কোটি টাকা, এখন এই সেভেন পার্সেন্টে শতকোটিতে পৌঁছাবে নিশ্চিত।

ভাগ্য এভাবে পায়ে লুটায়। স্বপ্ন দেখছে না তো!

আর তখনই মনে হয়, আজ সকালে আরেকটু হলে...। ভাগ্যিস। ভাগ্যিস।

ওদিকে ফরিদ বসে আছে ডা. ইমতিয়াজের ঘরে। ডাক্তার ইমতিয়াজ ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু ঘরে ঢুকলে রোগীদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেন, যেন ইয়ার্কি ফাজলামি করার জন্যই তিনি চেম্বার নিয়ে বসেছেন।

হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরেকটু হলে তাহলে গেছিলেন?’

‘একেবারে...আমি তো ভাবতেই পারিনি যে আপনার সামনে বসে কথা বলতে পারব।’

‘ঠিক কী ভেবেছিলেন একটু খুলে বলুন তো’

‘গাড়িটা যখন নিয়ন্ত্রণ হারাল, আমি সামনের সিটে বসা তো, দেখলাম যে রাস্তা ছেড়ে খাদের দিকে এগোচ্ছে

‘তারপর?’ ইমতিয়াজ এমনভাবে তাকিয়ে যেন কোনো থ্রিলার গল্পের প্লট শুনছেন।’

‘তারপর আর কিছু মনে নেই।’

‘ওহ হো, আসল জায়গাটাই মনে নেই। এই হল সমস্যা।’

সমস্যাটা কী বোঝা গেল একটু পর, ‘ডাক্তারি করতে করতে মানুষের এই মুহূর্তের বর্ণনা এত শুনেছি যে একঘেয়ে লাগে। ইচ্ছে হয়, ঠিক এরপর...। যখন বুঝতে পারছে সে শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন কী ভাবে? দুর, এই ব্যাপারটা আর কেউ মনে রাখতে পারে না।’

এই সমস্ত মানুষদের উপর রাগ থেকেই কিনা কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। চায়ে চুমুক দেন। তারপর উদাস গলায় বলেন, ‘আপনার টাকা-পয়সা কেমন আছে?’

‘আছে মোটামুটি।’

‘কত হবে সব মিলিয়ে।’

‘অ্যাসেট-ট্যাসেট মিলিয়ে দশ কোটি।’

‘গেল।’

‘জি। আমার কি সিরিয়াস কিছু?’

‘রিপোর্টগুলো দেখলাম। কিছু অসুখ আসে মানুষের টাকা-পয়সা কেড়ে নিতে। আপনার অসুখটা সেরকম। যতদিন টাকা খরচ করবেন, ততদিট সুস্থ থাকবেন। টাকা খরচে টান পড়লেই শেষ। ঐ গাড়ির মত, তেল শেষ তো আটকে গেল।’

বিরাট রসিকতা হয়েছে এমন ভঙ্গিতে তিনি হেসে ওঠেন।

ফরিদ হাসে না দেখে তিনি একটু অবাক, ‘ভাই রে আমি ভেবেছিলাম এর চেয়েও খারাপ কিছু। অসুখ হচ্ছে তিনরকম। একটা হল, আপনাকে খেয়ে ফেলবে, মানে আপনি শেষ। আরেকটা হল, কষ্ট দেবে, চাইলেও মরতে পারবেন না। আর, সবচেয়ে ভালোটা হল টাকায় ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনার তো সবচেয়ে ভালোটা হয়েছে। এক নম্বর গ্রেডের। এবার হাসুন। হাসতে থাকুন।’

ফরিদ হাসে না। তার মনে পড়ে, বড় ছেলেটাকে লন্ডনে পাঠানোর কথা এ বছর। ছোট ভাইকে একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দেয়ার কথা। আরও কত কী! সব বাদ দিয়ে নিজের পেছনেই সব টাকা ঢালতে হবে!

কেন যেন একটা শূন্যতার বোধ তৈরি হল!

একবার মনে হয়, সকালে দুর্ঘটনা ঘটে গেলে মন্দ হত না। একবারেই সব শেষ হয়ে যেত। এখন নিজে বেঁচে থাকবে কিন্তু বাকিদের সব শেষ করে দেবে। তারপর যখন মারা যাবে একদিন, তখন ছেলে-মেয়েদের...। আর ভাবতে পারে না।

ততক্ষণে শাহিন একটা বিরাট ঝামেলায় ফেঁসে আছে। ঢাকায় প্রতি দুই-তিন সপ্তাহ পর সে একবার করে আসে। খুবই গোপনে। এবারও তাই ওদের সঙ্গে আসতে রাজি হয়নি, পরে দেখল এখন ওদের এড়িয়ে কিছুদিন পর গেলে বরং আরও সন্দেহ দেখা দেবে। সে আসে ডলির সঙ্গে সময় কাটাতে। নিজের শহরে এই সুযোগ নেই। একটু মান্যগন্য হওয়ার এই অসুবিধা। সবাই চোখে চোখে রাখে। বড় সরকারি কর্তা বলে কখনোই নজরের বাইরে নয়। তাই ঢাকার একটা হোটেলই মিলিত হওয়ার একমাত্র জায়গা। তাও কত কী ম্যানেজ করতে হয়। জেনারেল ম্যানেজারকে মাসোহারা দিতে হয়। রুমে ঢুকতে হয় প্রায় মুখ ঢেকে। মাস তিনেক আগে লবিতে পরিচিত এক কন্ট্রাকটরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ব্যাটা কিছু বুঝেছে কি না কে জানে কিন্তু বিল ছাড়াতে এলে প্রায়ই মনে করিয়ে দেয়, ‘স্যার, যাবেন নাকি ঢাকা। চলেন একসঙ্গে একবার।’

ইঙ্গিতটা শাহিন বুঝে। এই কন্ট্রাকটররা মনে করে বিল তাড়াতাড়ি ছাড়ানোর একটাই উপায়। কর্তাদের মেয়ে ধরিয়ে দেয়া।

সে ঠিক এই অভ্যাসের নয়। কিন্তু ডলির ব্যাপারটা আলাদা। প্রথম পরিচয় অবশ্য হয়েছিল এভাবেই, পরিচিত একজন তাঁর কাছে তদ্বিরের জন্য পাঠিয়েছিল। মেয়েটার স্মার্টনেসে সে মনযোগ দিতে বাধ্য হয়। এবং তারপর শরীর পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়াল। এরকম আরও কোনো কোনো সময় গড়িয়েছে কিন্তু এই গড়ানোটা গড়িয়ে চলে গেল না। আটকে গেল। এটা প্রেম! সে ঠিক বুঝে না। এমন নয় যে সবসময় ভাবে কিন্তু এক-দেড় সপ্তাহ গেলেই পাগল-পাগল লাগে। ডলিকে নিয়ে একান্তে দিন না কাটালে কিছুতে মন বসে না। সে টাকা দেয়, কিন্তু সম্পর্কটা যেন ঠিক টাকার নয়। এর সঙ্গে আরেকটা কৌতূহল। ডলিও কি তাঁর জন্য এমন তীব্রতা বোধ করে। কোনোদিন মনে হয়, হ্যাঁ। আবার  পরমুহূর্তেই মনে হয়, দুর। না। একবার সে দুই মাস যোগাযোগ করল না। ডলির দিক থেকে কোনো আওয়াজ নেই। সে ধরে নিল, এ শুধু টাকা আর শরীরের অঙ্ক। কিন্তু পরেরবার সপ্তাহ যেতেই ডলির ফোন। একবার টাকা কম দিয়ে পরীক্ষা করল। ডলি খুশি। আরেকবার টাকা গুণে বলল, দুই হাজার কম আছে। সে বুঝতে পারে না। এ বোধহয় বোঝা যায় না।

ডলি এসেছিল সময়মত। তাঁর একটু আগেই। সব হয়ে যাওয়ার পর দরজায় ধাক্কা। এ-ও এমন কোনো সমস্যা নয়। বয়-বেয়ারারা বুঝতে পারে কোন সময় গেলে বেশি বকশিশ পাওয়া যায়।

কিন্তু দরজা খুলতেই বিশাল শরীরের এক দশাসই যুবক ঢুকে পড়ে প্রচ- ঘুসি মেরে বলে, ‘লুচ্চামির জায়গা পাও না শালা’

শাহিন বিস্মিত। সব তো সেট করা। সরাসরি লোক আসে কী করে।

মানুষটি ডলির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি..ছি-ছি, আমি ভাবতেও পারছি না।’

ডলি মাথা নীচু করে থাকে।

মানে কী!

মানুষটা বলে, ‘আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু হাতে নাতে ধরতে পারছিলাম না।’

শাহীন ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি ওকে চেনো?’

‘চিনবে না কেন?

‘ডলি, ইনি কে?’

‘বল দুশ্চরিত্র মেয়ে।’

ডলি বলে, ‘আমার হাজব্যান্ড।’

শাহিন সঙ্গে সঙ্গে সব বাদ দিয়ে মানুষটির সঙ্গে নিজের তুলনা শুরু করে। এ সুপুরুষ তার চেয়ে। দেখতেও ভাল।

অদ্ভুত কারণে একটা হারের অনুভূতি হয়।

মানুষটি বলে, ‘মাল ছাড়ু-ন।’

শাহিন অবাক, ‘আপনি স্বামী না ওর?’

‘এজন্যই তো বলছি, আমার বউয়ের ফি আমি পাব না।’

শাহিনকে অগত্যা দশ লাখ টাকার চেক লিখে দিতে হয়। মানুষটি চেকটা নিয়ে চলে গেলে, তার ঠিক আর ডলির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। ডলি যে বিবাহিত, ওর সংসার আছে, তা নিয়ে সে মাথা ঘামায়নি, ঘামানোর কথাও না। ওর নিজেরও তো সংসার আছে। কিন্তু আজ বাস্তবে সে-ই মানুষটি সামনে আসার পর কেমন যেন লাগে। জানা সত্য আর চোখের সামনে হাজির হওয়া সত্যের অনেক পার্থক্য। দ্বিতীয়টা যে ্এমন তীব্র সে জানতই না।

ডলি বেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ পর।

শাহিন চুপচাপ বসে থাকে আধঘণ্টার মত। ব্যাংক থেকে ফোন আসে। অন্য ব্রাঞ্চ বলে ওরা নিশ্চিত হতে চায়, চেকটা ওরই তো। সে হ্যা বলে নিচে নামে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে দেখে নিজেকে আড়াল করে ডলি দাঁড়িয়ে। কেন?

সে-ও দাঁড়ায়। নিজেকে প্রকাশ না করেই।

মিনিট কয়েক পর মানুষটা টাকার ব্যাগ নিয়ে বেরোয়। তারপর ডলি গিয়ে ওঠে তাঁর গাড়িতে।

শাহিনের সকালের অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা মনে পড়ে। উফ, তখন সব শেষ হয়ে গেলে কী ভাল হত! এই প্রতারণাটা দেখতে হয় না।

আবার মনে হয়, না, ভালোই হয়েছে। এর একটা বদলা নেয়া যাবে।

ফিরতি গাড়িতে ওরা তিনজন। অভিজ্ঞতার কারণে ফরিদ এখন খুব সাবধান। আর গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারাবে না।

ওরা চলতে থাকে। কিছু গাড়ি পেছন থেকে ওদের পেরিয়ে যায়। উল্টা দিক থেকে ছুটে আসছে অনেকগুলো। কেউ কেউ আবার থেমে আছে।

একটা অদ্ভুত জিনিস। থেমে থাকলে সবাই এক রকম। অথচ চলার পথটা কত রকম!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর