শিরোনাম
শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

গাছের ছায়ায় আলোর মায়ায়

হুসেইন ফজলুল বারী

গাছের ছায়ায় আলোর মায়ায়

ওই তো, গাছের ছায়ায় ছুটে চলেছে তরুণ-তরুণীর দল। তাদের গন্তব্য শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ধাবমান শিক্ষার্থীদের অনুসরণ করে আমিও এগোই এই আলোর মায়ায়। উত্তর বিলেতের এ শহরটির প্রাণ বলতে উচ্ছল শিক্ষার্থীর দল। কাঁধে ল্যাপটপ আর হাতে কফিমগ নিয়ে তারা হাঁটে ফুটপাত ধরে। মন্থর পায়ে চলতে অভ্যস্ত বাঙাল-আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে গিয়ে দু-এক বার হোঁচটও খেয়েছি। বলা প্রয়োজন, ৬ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত শেফিল্ড নগরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাই ৬০ হাজার। শিক্ষক আর কর্মচারী আরও হাজার তিরিশেক। শিক্ষাগুরুদের তত্ত্বাবধানে চোখে স্বপ্নের অঞ্জন মেখে এখানকার শিক্ষার্থীরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। রাসেল গ্রুপের সদস্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি সবার বিকাশের সব আয়োজন সাজিয়ে রেখেছে। উৎসুক জ্ঞানার্থীর ভিড়ে আমিও একজন। আমাদের ডক্টরাল কলেজের ঝানু টিউটররা গবেষণার রীতি, লিটারেচার রিভিও, একাডেমিক লিখন, গবেষণা উপস্থাপনা আর রেফারেন্সিংয়ের নিবিড় প্রশিক্ষণ দেন। ফাঁকি দেওয়ার একদম সুযোগ নেই।  আছে আবশ্যিক সেলফ-স্টাডির প্যাক, নবীন গবেষকদের মানসিক স্বাস্থ্য সুষম রাখার কোর্স।

আমি গবেষণার কাঠামো মুসাবিদা করার এরাদায় ওয়েস্টার্ন লাইব্রেরিতে গিয়ে হাজির হই। সনাতন আমি সত্যিকারের বইয়ের বিশাল সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হই। কিছুক্ষণ বই-জার্নাল ঘেঁটে বিরক্ত হয়ে থামি। জ্ঞানের যে কত ধারা-উপধারা! অনলাইনে টোকা দিলে নিমিষেই ইলেকট্রনিক মাকাম থেকে শত-সহস্র জার্নাল, বই, প্রতিবেদন এসে হাজির হয়। যত আনকোরা কিছু পড়ি ততই নিজেকে অজ্ঞ মনে হয়। আশপাশে একঝাঁক স্বর্ণকেশী-কৃষ্ণকেশী সহপাঠীর ভিড়। চোখ বন্ধ করে ভাবী, বঙ্গেয় বদ্বীপ থেকে যেহেতু এসেই পড়েছি, তাই এত সমৃদ্ধ আয়োজনে কোমর বেঁধেই নামব। ফিরতি পথে এক সহকারীর ফিসফিস কথায় মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটে যখন শুনি, নোবেলজয়ী কবি টি এস এলিয়ট এ পাঠাগারটি উদ্বোধন করেন। এগিয়ে গিয়ে দেখি, এই মহান কবির বেশ কিছু স্মারক এখানে সযতেœ রক্ষিত।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে একটু বাঁক ঘুরে সামনে এগোই। এদিকে বাগানবিলাস -ছাওয়া একটি লাল দালান। বাইরের দিকটা পুরান ঢাকার জেলখানার মতন দেখায়। এরই নাম ‘ফাথ কোর্ট’। নামে কোর্ট হলেও এখানে কোনো আইন-আদালত বা থানা-পুলিশের কারবার নেই। ‘মাক ফাথ’ ছিলেন সবচেয়ে বৃহৎ ইস্পাত কারখানার মালিক। সমৃদ্ধ মানুষটি শেফিল্ডের মেয়র নির্বাচিত হয়ে এ জনপদের উন্নয়নে মনোনিবেশ করলেন। মহানুভব ফাথ নগরবাসীর শিক্ষা বিস্তারের জন্য নিজ অর্থব্যয়ে প্রতিষ্ঠা করলনে এই লাল ইটের কলেজ। বিশ শতকের শুরুতে এ কলেজ থেকেই শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিষেক হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ আঁতুড়ঘরে বসে বিজ্ঞানী হ্যান্স অ্যাডলফ্ ক্রবেস বিজ্ঞান গবেষণায় নতুন দিগন্ত এঁকে নোবেল বিজয়ী হন। জার্মান এই চিকিৎসক হিটলারের নাৎসি রাজত্ব ছেড়ে শেফিল্ডে এসে জৈবরসায়নের রাজকুমার হয়ে উঠলেন। তাঁর গৌরবময় পদাঙ্ক অনুসরণ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আধাডজন বিজ্ঞানী বিভিন্ন সময়ে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ভবনটির প্রবেশমুখেই তাঁদের কীর্তির কথা সোনালি হরফে লেখা। গলায় নীল পরিচয়পত্র আর বরফশুভ্র অ্যাপ্রোন গায়ে চাপিয়ে এখানকার গবেষকরা একটানা কাজ করে ক্রবেস ক্যাফে গিয়ে গরম কফিতে চুমুক দেন। সেখানে একটি মেয়ে কেশঝোড় নাড়া দিয়ে কম্পিউটারে চোখ স্থির করে অলস অবহেলায় পিস্টের খায়। এদিকে তার চা জুড়িয়ে হিম। চা মুখে দিয়ে বিশাল আকারের পোড়া আলুতে কামড় দিয়ে অবাক হই, এ বিস্বাদ খাবারই বিজ্ঞানী ক্রবেসের খুব প্রিয় ছিল!

ফিরতি পথে দেখি এক অন্যমনস্ক প্রফেসর দেয়ালে হেলান দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। তাঁর ঋজু কাঁধের ওপর দিয়ে ইউনির্ভাসিটির নীল-সাদা মনোগ্রামের উজ্জ্বল সাইনবোর্ড দেখা যায়। সূর্যের আলো এ প্রতীকে বাড়ি খেয়ে আবার তেরচা হয়ে ফিরে যায় নীল দিকচক্রবালে। সেদিকে হস্তীযূথের মতো মেঘেরা ভেসে বেড়ায়। বুড়ো দালানের গায়ে গাছের ছায়ারা দোল খায়। লতাশোভিত দ্বারের কাছে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী টেবিল সাজিয়েছে। তাদের হাতে জলবায়ু সম্মেলনের সাদাকালো প্রচারপত্র। পাথুরে বেদিতে পা ছড়িয়ে বসা একঝাঁক শিক্ষার্থীর দল নিজেরা হাসিঠাট্টায় মুখর। কয়েকজন তরুণ দীর্ঘ দুরবিন কাঁধে সামনে এগোয়। প্রজাপতির মতন এক উজ্জ্বল মেয়ে সবার আগে আগে ঘোরে। জ্ঞানসন্ধানীদের চোখ-মুখে আলোর নাচন। এক প্রতিবন্ধী মেয়ে র‌্যাম্পে উঠে দীপ্তহাতে হুইল চেয়ার চালিয়ে ল্যাবে ঢোকে। এক জোড়া স্বাস্থ্যবতী বহিগ ফুলের বাগানে তরতর করে হাঁটে। সাদাকালো এ ম্যাগপাই পাখিগুলো আমাদের দেয়ালের অন্তত তিন-চার গুণ বড় হবে। সযতেœ লালিত ফুল লতাশুদ্ধ শুকিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে শুঁকে দেখি বিলেতি এসব ফুলের কোনো সৌরভও তো নেই। কালো ইউনিফর্ম-পরা প্রৌঢ় মালী বিষণœমুখে খুরপি দিয়ে মাটি কোপায়, মরা শিকড় টেনে তোলে আর বিড়বিড় করে বকে। নিবিড় গাছপালার পাশে তিনজন ঝলমলে তরুণী কী যেন বলতে বলতে খঞ্জনা পাখির মতো হুটোপুটি খায়। কৃষ্ণাঙ্গী যুবতীটির গায়ের ওপর থেকে জীর্ণ পাপড়ি ঝরে পড়লে সে ভ্রু কুঁচকে কোনাকুনি তাকায়। সেদিকে লালরঙা শিশু হাসপাতাল দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। এই চিকিৎসালয়ের জবুথবু প্রকোষ্ঠে বসেই বিজ্ঞানী অ্যালেকজান্ডার ফ্লিমেং প্রথম পেনিসিলিনের সফল ট্রায়াল সম্পন্ন করেন। যে মানুষের জীবন বা সুস্থতা ছিল প্রকৃতির খেয়ালের ব্যাপার, সে-মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক হাতে নিয়ে রোগশোকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এখান থেকেই।

 

পাশের সোফার তরুণী বিড়বিড় করে, ‘আমি দুর্ভাগ্য কনে?’। রূপবতী তরুণীটির এ দুঃখবিলাসের কারণ জানি না। উৎসুক অনেকে হল্লা করে। একদল ককেশীয় স্বল্পবসনা তরুণী নেচে-গেয়ে কার্পাস তুলোর মতো ফেটে ফেটে পড়ে। বেরিয়ে এসে শুনি, আশপাশে কোথাও একটা রাতজাগা পাখি একটানা কেঁদে চলেছে করুণ স্বরে।  ঠান্ডা বাতাস ছাপিয়ে শরীরে গুঁড়া ঝরে পড়ে। ক্লান্ত পায়ে ফিরে চলি স্টুডেন্ট ডেম

 

এ হাসপাতালের উল্টো দিকে অনিন্দ্যসুন্দর ওয়েস্টার্ন পার্ক। এর গা-ঘেঁষে ইটরঙা আইন অনুষদ। আজ আমার সহযাত্রী গ্রিক মেয়ে মারিয়া। হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলাম, ত্যাড়াব্যাড়া পথের পাশে চিরাচরিত ঝাউ গাছের সারি। নরম হাওয়া এসে এদের গায়ে আলতো ছোঁয়া দেয়। বেশ ঠান্ডা বাতাস, একটু যেন কেঁপে উঠি। পাশেই অবতল মাঠের মতো প্রাণময় ক্রুক্স ভ্যালি পার্ক। সুন্দরী যমজ বোনের মতো গলাগলি ধরে দুই উদ্যান এ জনপদের শোভাবর্ধন করে চলেছে শত শত বছর। সবুজ প্রান্তরজুড়ে রঙিন ফুলের বন্যা। কিছু ফুলের পাপড়ি মরে গিয়ে ঘাসের বুকে শয্যা পেতেছে। এ মনোরম জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন লম্বা মানুষ হাই তোলে। দ্রুতলয়ে সামনে এগোই। একঝাঁক লতা গাছে ঝুলে আছে রাশি রাশি বুনোফল। বটের মতন ছোট ছোট আকার, তবে রং যেন সিঁদুরমাখা। ঝিরঝিরে পাতায় মৃদু বাতাস এসে চামরের দোলা দেয়। কয়েকটি ফল ঝুপ ঝুপ করে ঝরে পড়ল কালচে জলে। বোবা হাঁসের দল নির্বিকার হয়ে এ জলাশয়ের এক কোণে সাঁতরে বেড়ায়। এ লেকের কালো পাড় যেন কচ্ছপের পিঠ। সেদিকে ডাহুকের মতন দেখতে কয়েকটি পাখি গম্ভীর হয়ে হাঁটে। আশপাশেই অজস্র কবুতর লাল চঞ্চু কাঁপিয়ে বকবক করে। আমার এ উপমা শুনে মারিয়া লাল ঠোঁটে হাসে। কিছু ত্রস্ত পাখি ডানা ঝাপটায়। ভিজে মাটিতে কপোতের দল মায়াবী ছন্দে হেঁটে হেঁটে খাবার খোঁজে। এদের লাল ঠ্যাংয়ের ছাপ লেগে নরম বালিতে মনোহর প্রচ্ছদ অঙ্কিত হয়। আমি এ উপমার কথা ভাবতে ভাবতে লক্ষ্য করলাম, কয়েকটি ঝরাপালক, বেরি ফল, শুকনো পাতা জলমগ্ন কাঁদায় গেঁথে রয়েছে। মারিয়া এসব এড়িয়ে বুট পায়ে মাতঙ্গিনীর মতো হাঁটে। ছায়াতরুর ঝাঁক জলের ওপর ঝুঁকে আছে মুগ্ধ হয়ে। চিরসবুজ ক্রিসমাস গাছের পাশে এক জুটি নিজেদের নিয়ে নিমগ্ন। অদূরে একটি উঁচু ঘর, এখানে একসময় নাকি যুদ্ধের ব্যান্ড বাজত। এর পুরো দেয়ালে পৌঁছে বিকালের রোদ নেতিয়ে পড়েছে। নিরিবিলি দুপুরে বনস্পতির ছায়ায় এক ঝুঁটিয়াল লোক মগ্ন হয়ে ছবি আঁকে। তাঁর পায়ের কাছে নীল ডায়েরি, রঙের কৌটা, ছবি আঁকার এলোমেলো সরঞ্জাম। বুনি দুলিয়ে এক তরুণী মা স্কুল-ফেরত যমজ শিশুকন্যাকে নিয়ে হাঁটছেন। একটু থেমে শিশুরা টুকটুক স্বরে কথা বলে একটি বড় পাতায় একমুঠি বাদাম ছিটিয়ে দিল। ছোঁচা কাঠবিড়ালির দল গাছের গা বেয়ে নেমে এসে লেজ নাচিয়ে চিঁ চিঁ ডাকে-হুড়োহুড়ি করে খাবার খায়। চলমান চাইনিজরা গড্ডলিকার পাল হয়ে মিটিমিটি হাসে। কেউবা ধূসর বেঞ্চিতে বসে রোদ পোহায়। অনেকের হাতে লাঞ্চবক্স-কফিমগ। একটি বেদিতে বসে আমরা দুই সহপাঠী ঔপনিবেশিক আইন নিয়ে বেশ উঁচুলয়ে তর্ক করি। রোদছায়ার লুকোচুরি শেষে চারধারের বেলা গড়িয়ে যায়। সবকিছু কেমন যেন নিঝুম দেখায়। কিছু পাখি ডানা মেলে ঊর্ধ্বপানে। ক্লান্ত প্রবীণরা পোষা কুকুর নিয়ে অলস পায়ে আবাসের দিকে ফিরে চলে। ভবঘুরে এক লোক কাঠের বেদিতে বসে মলিন কোট থেকে সুরার বোতল বের করে। হাঁটতে হাঁটতে সহপাঠী মারিয়া বলল, ব্রিটেনে এরূপ উদ্যান ভিখিরি থেকে রাজা সবার জন্য উন্মুক্ত। ১৯০৫ সালে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড এ পার্ক পরিদর্শন করে শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির আনুষ্ঠানিক পথচলার শুভ সূচনা করেন। কিন্তু এখানে কোনো রাজপুরুষের মূর্তি নেই। রয়েছে স্থানীয় সমাজ সংস্কারক এলিয়টের বিশাল ভাস্কর্য। ১৮১৫ সালে রাজা ‘শস্য আইন’ জারি করে গমের ওপর কর বাড়ালে এ দুর্বল পদ্যকার গণমুখী রাজনৈতিক আন্দোলনে নামেন। এলিয়ট রচিত গণসংগীতগুলো গাওয়া শুরু হলে তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। উচ্চবিত্ত মানুষটি তাঁর মালিকানাধীন কারখানা বিক্রি করে সাধারণ মানুষ হয়ে যান। কিন্তু মানুষের চোখে তিনি আসলে হয়ে ওঠেন অসাধারণ। তাঁর নেতৃত্বে এ অঞ্চলের গণমানুষের ঐক্য সুদৃঢ় হয়। ১৮৪৬ সালে ‘শস্য আইন’ নামক কালাকানুন বিলোপ হয়। ফলে সাধারণ মানুষের ন্যায্যমূল্যে রুটি খাওয়ার সুযোগ হয়। আমি প্রশ্ন করলাম, অবশ্য খাদ্য, ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা, মুক্তবাকের সংগ্রাম কি এখনো চলমান নয়? গ্রিক তরুণী মারিয়া পুরন্ত ওষ্ঠ বাঁকিয়ে আমার দিকে সরু চোখে তাকায়। জানি না, মারিয়াদের মতন অনলাইন আসক্ত কেয়ার-ফ্রি তরুণ-তরুণীদের এসব ভাববার কি সময় আছ? বুর্জোয়া চিন্তাশ্রিত পড়াশোনার তীব্র চাপ এড়িয়ে কেউ কি আর সমাজ ভাঙার স্বপ্ন দেখে? বিশ্বায়নের যুগে সব পণ্য আর সুযোগ-সুবিধার অবাধ যাতায়াত। কিন্তু হাভাতের কষ্ট যে এখনো শৃঙ্খল তা কার এমন দায় পড়েছে অকারণ কষ্ট পাবার, কেন ইয়েমেনের নিরপরাধ মানুষ না খেয়ে মরে? কেন উত্তাল সাগরে নিরীহ রিফিউজির সলিলসমাধি হয়?

আত্মমগ্ন সহপাঠিনীকে নিয়ে হেঁটে চলি সামনের দিকে। এখানকার সবুজাভ-প্রান্তরে গেবাদ্ধত শেরি দাঁড়িয়ে আছে একটি স্মৃতিফলক। দুই বিশ্বযুদ্ধে শহীদ এ এলাকার হাজার দশেক তরুণের স্মরণে স্থাপিত হয়েছে এ ফলক। শ্বেতপাথরের এ ভাস্কর্যে দুই যোদ্ধার প্রদীপ্ত অবয়ব আর সন্তানহারা মায়ের বেদনা একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এর আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাতাবিরল গাছগুলোকে ভিখিরির মতো বেশ নিঃস্ব দেখায়। চারপাশের ঘাসের ফেরাস হলদেটে পাতার স্তূপ জমেছে। বাতাসের ছোঁয়ায় অবশিষ্ট বাসিপাতা ঝরে পড়ে গাছের শিকড়ে, ধূসর মাটিতে, মরণাপন্ন ঘাসের মখমলে। বেলা একদম পড়ে এসেছে। গাছের ছায়া দীর্ঘতর হয়। ছায়ার রাজ্যও বিষণœ হয়। দিনের শেষের আবছা ধূসরতা নেমে আসে প্রান্তরজুড়ে। পাহাড়ের আগায় কুয়াশার আবছায়ার মতো কিছু দেখি যা আবার চকিতেই হারিয়ে যায়। সাঁঝের মায়ায় ভিজে আমরা হাঁটি সামনের দিকে। হতচ্ছাড়া আঁধার নামে তিরতিরিয়ে। হিমেল সন্ধ্যা গাঢ়তর হয়। দূরাগত বাতাসের প্লাবন শুনি। লতাপাতায় নাচন লাগে। হাতির কানের মতন দেখতে কিছু পাতায় পতপত শব্দ হয়। পাশের উদ্যান থেকে বুঝি বীরপ্রসূ মায়ের বিলাপের মতন বনজ হাহাকার ভেসে আসে! ভূপাতিত পাতার গায়ে কুয়াশা এসে মায়াময় ছোঁয়া দেয়। বাতাসে কুসুমগন্ধ। ঠান্ডা এসে আঙুলের ডগায় সুচের মতন বেঁধে, কানে লাগে। আমি বাদুড়ে টুপি পরে নিলাম। কবজিতে-আঁটা স্মার্টওয়াচ সংকেত দিচ্ছে, এখন তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি যা শেষরাতে হবে শূন্য। বরফরঙা সহপাঠিনী মারিয়া দস্তানা পরতে পরতে উৎসুক ঠোঁটে বলল, হুসেইন, আজ কি বরফ পড়বে? চল, স্টুডেন্ট ইউনিয়নে গিয়ে গরম গরম পোটুটে খাই। লক্ষ্য করলাম, তার চোখ তিরতির করে কাঁপছে। গ্রিক তরুণীর টিকালো নাকও যেন ফুলে ফুলে ওঠে। আমি হেসে স্বগতোক্তি করি এভাবে, ঠিক যেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা, সামাজিক সমস্যা, অর্থনৈতিক অসাম্য ও সাংস্কৃতিক পীড়ন নিয়ে রচিত কবি টি এস এলিয়টের আকর কাব্য ওয়েস্টল্যান্ডের নতুন পটভূমি।

ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চোখে পড়ে, রাস্তার মোড়ে নির্মাণাধীন ভবনের পাশে এক জড়সড়ো মানুষ নোংরা পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে তার ভিক্ষার-সংসার সাজিয়েছে। একপাশে তার রংজ্বলা গিটার। সে বিষণœ মুখে গিটারের তারে আঙুল রাখে- টুংটাং সুর বাজে। ব্যস্ত পথচারীরা পাশ ফিরে চলে যায়। মারিয়া একটু থেমে শিল্পীর বাক্সে পয়সা ছুড়ে দিলে ঝনঝন শব্দ হয়। শুনলাম, এ এলাকায় ইদানীং রিফিউজির উৎপাত শুরু হয়েছে। মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে নাকি ঠ্যাঙানিও দেয়। সামনেই দেখি জ্বলজ্বলে পাব আর বার। এত দিনে আমিও জেনে গেছি, যে বিল্ডিং যত পুরনো, সে-পাবও তত মশহুর। একটু উষ্ণতা পেতে, তৃষ্ণা মেটাতে ডায়মন্ড লাইব্রেরি থেকে অন্যান্য শিক্ষার্থীও নিচে নেমে আসে। ইনফরমেশন কমন্স লাইব্রেরির ডেস্কে বসে কিছু নাছোড়বান্দা শিক্ষার্থী তখনো গবেষণার নতুন সমীকরণ আঁকায় মগ্ন। এসব বেরসিক গবেষকের সামনে মোটা মোটা বইয়ের স্তূপ। এ পাঠাগার দুটির দ্বার টার্মের সময়ে ২৪/৭ খোলা থাকে। অবাক হলাম, পাঠকদের জন্য এখানে টয়লেট-বেসিন ছাড়াও শাওয়ারের বন্দোবস্তও আছে। পড়তে পড়তে তালু গরম হয়ে গেলে অনেকে নাকি এখানে স্নান সেরে মাথা ঠান্ডা করে নেয়!

সপ্তাহান্ত বলে ছাত্রছাত্রীদের আড্ডায় স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বিল্ডিং বেশ জমে উঠেছে। সহপাঠীরা কেউ আসে জুটি বেঁধে। কেউ হাজির হয় একা-বিষণœ। যূথবদ্ধ অনেকে আসে হইচই করে। বিভিন্ন বারে উৎসব-পার্বণে ডিসকাউন্ট দিয়ে খদ্দের আকৃষ্ট করার একটা প্রবণতাও দেখা যায়। আছে হ্যাপি আওয়ারের সুযোগ। কুইজের সঠিক জবাব দিয়ে মারিয়া পায় ফ্রি পানীয়। প্রাণবান ছেলেমেয়েদের আড্ডা চলছে অবিরাম। পেছনের ছোট্ট বাগানে বসে কেউ কেউ আরামসে ধূমপান করে। লক্ষ্য করলাম, সিংহভাগ ধূমপায়ীই মেয়ে। লাল-ঠোঁটে তপ্ত চুরুট! আমার গেঁয়ো চোখে কেমন যেন বিসদৃশ লাগে। নেতাগোছের একজন মাইক নিয়ে পরদিন অনুষ্ঠেয় বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ক আলোচনার কথা মনে করিয়ে দেয়। এক তরুণী চোখ মুদে গিটার বাজাতে শুরু করলে সবার আড়ষ্টতা কেটে যায়। আগ্রহীরা নড়েচড়ে বসে। কেউ কেউ চুপচাপ গলা ভেজায়। ফায়ারপ্লেস জ্বলে ওঠে। সবাই ক্লোকরুমে কোট-গাউন ঝুলিয়ে রাখে। স্বল্পবসনা তরুণীদের দেহের বিভঙ্গ বেশ স্পষ্ট হয়। অনেকে চিয়ার্স বলে গেলাসের ঠোকাঠুকি শুরু করে। হাসি হাসি মুখ করে কেউ কেউ আপনি নাচে। কিশোরী রাত বেড়ে যুবতী হয়। লাস্যময়ী রাতের বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন কাব্য জমে। কেউ একটা চুটকি বললে হাসি সংক্রমিত হয় আশপাশে। ভোজনে ও পানে আমি শুদ্ধাচারী হলেও এ প্রাণময় মজমায় এসে বেশ লাগছে। মৃদুলয়ের সংগীত ক্রমে উদারা-মুদারা পার হয়ে তারায় গিয়ে ঠেকে। নানান কিসিমের ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে আর নেভে। অপূর্ব সব আলোর নকশা ছড়িয়ে পড়ে হলজুড়ে। শিক্ষার্থীরা হরেক রকম আলোকধারায় ভিজে ভিজে চুমুকে চুমুকে শান্তি খোঁজে। পাশের সোফার তরুণী বিড়বিড় করে ‘আমি দুর্ভাগ্য কনে?’। রূপবতী তরুণীটির এ দুঃখবিলাসের কারণ জানি না।  উৎসুকরা অনেকে হল্লা করে। একদল ককেশীয় স্বল্পবসনা তরুণী নেচে-গেয়ে কার্পাস তুলোর মতো ফেটে ফেটে পড়ে। বেরিয়ে এসে শুনি, আশপাশে কোথাও একটা রাতজাগা পাখি একটানা কেঁদে চলেছে করুণ স্বরে। ঠান্ডা বাতাস ছাপিয়ে শরীরে গুঁড়ো ঝরে পড়ে। ক্লান্তপায়ে ফিরে চলি স্টুডেন্ট ডেম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর