শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

অবরুদ্ধ সময়ের যন্ত্রণাকাতর কবি সমর সেন

তুহিন ওয়াদুদ

অবরুদ্ধ সময়ের যন্ত্রণাকাতর কবি সমর সেন

সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭) বাংলা কবিতার ইতিহাসে অপরিহার্য উচ্চারিত নাম। তার জীবনকাল বিস্তৃত হলেও তার কবিতাঙ্গনে বিচরণের কাল সীমিত। তিনি কেবল কবি নন, কবিতাবিষয়ক প্রাজ্ঞজন। কবিতাকে তিনি কখনো নিছক আবেগের কিংবা কেবল অকারণ প্রাণ উৎসারিত শিল্প বলে স্বীকার করেননি। নিখাদ বাস্তবতার পটভূমিতে রচিত হয় প্রকৃতি কবিতা। সময় অলঙ্ঘনীয় প্রভাববিস্তারী। তিনি কবিতা সম্পর্কে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানেই তার কবিতার অন্তর্গত বিশ্লেষণ চোখে পড়ে। তিনি নিজে যে সময়ে লিখেছেন সেই সময় সম্পর্কে লিখেছেন- ‘যতদিন পর্যন্ত ভারতবর্ষে আমূল সমাজবিপ্লব না-ঘটে, কুটিল কালচক্রে ভাঙন না-ধরে ততদিন এই নিঃসঙ্গতা, হতাশা আর অবিশ্বাস বর্তমান সভ্যতার যেগুলি বিশেষত্ব, তাদের ঘিরে থাকবে, ততদিন তাদের শ্রেষ্ঠ রচনা প্রাণবান মূলসূত্রের অভাবে পীড়িত হবে।’ ঔপনিবেশিক শাসনামলকে তিনি ‘দাসদেশ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

কবি সমর সেন বলতে গেলে মাত্র ১২ বছর কাব্য চর্চা করেছেন। এই কবিজীবনে তিনি লিখেছেন “কয়েকটি কবিতা” (১৯৩৭), “গ্রহণ” (১৯৪০), “নানাকথা” (১৯৪২), “খোলা চিঠি” (১৯৪৩) ও “তিন পুরুষ” (১৯৪৪) কাব্য গ্রন্থ। তিনি কবিতার আঙিনা থেকে স্বেচ্ছাবিদায় কেন নিয়েছেন  সে পরিপ্রেক্ষিত এখন আলোচনার বিষয় নয়। সময়ের প্রভাবজাত নিঃসঙ্গতা কবিকে সংক্রমিত করেছে, সেই সত্যতা কবির কবিতায় বারবার উঠে এসেছে।

সমর সেনের কবিতাঙ্গনজুড়ে বেদনাবিধুর অনুভূতির বিস্তৃতি। তার প্রথম পর্যায়ের কবিতামালায় কিছু শব্দ ঘুরে-ফিরে এসেছে। তার কবিতায় রাতের আকাশ এসেছে। অন্ধকারে ভরা সে আকাশ। অন্ধকার শব্দটি প্রয়োগ কোনো কোনো কবিতায় একাধিকবার এসেছে। ‘ক্লান্তি’ শব্দেরও ব্যাপ্তি আছে। বিষাদের কথা এসেছে অসংখ্যবার। নিঃসঙ্গতার আলাপন পুনরায় পুনরায় উঠে এসেছে। নিস্তব্ধতা কিংবা নিঃশব্দ অবস্থার মধ্যেও বেদনাকে ধরার চেষ্টা করেছেন। হাওয়ার কথা লিখেছেন। যে হাওয়ার মধ্যে নৈঃসঙ্গচেতনার বিনির্মাণ।

সুনীল আকাশ তার কবিতায় অনুপস্থিত। তার কবিতায় এমন কোনো শব্দ সম্ভারের গাঁথুনি নেই যে প্রশস্তির বার্তা বয়ে আনে। মিলনের পরিবর্তে বিরহের আখ্যান তার কবিতা। ‘কটি রাত্রের সুর’ কবিতায় আছে- ধূসর সন্ধ্যায় বাইরে আসি/ নির্জন প্রান্তরের সুকঠিন নিঃসঙ্গতায়।/ বাতাসে ফুলের গন্ধ,/ আর কিসের হাহাকার।’ ‘নাগরিকা’ কবিতার সরল পাঠে কবিবোধের যে স্ফুরণ সেখানেও অভিন্ন সুরই বেজে ওঠে। ‘ক্ষুধার্ত দীপ্তি, কঠিন ইশারা, হিংস্র হাহাকার’ আছে এমন এক মেয়ের কথা বলেছেন কবি। সে চোখে অনুপস্থিত নীলার আভাস কিংবা সমুদ্রের গভীরতা। কবিতার শুরুতেও পরিণতির সুর উপলব্ধি করা যায়- ‘ যে পথে নিঃশব্দ অন্ধকার উঠেছে ঘন হয়ে/ ক্লান্ত স্তব্ধতার মতো,/ সে পথে দক্ষিণ হতে হঠাৎ হাহাকার এলো।’

‘পাড়হীন অন্ধকার’ অনভূতিময় কবিতার নাম ‘দুঃস্বপ্ন’। প্রত্যেক চরণে, স্তবকে দুঃখের সংগ্রহ। কবিতার পূর্ণতা দুঃস্বপ্নের পূর্ণতারই নামান্তর। কবি প্রিয়জনের চোখে বাসনার বিষণœ দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। সেটাকেই দিয়েছেন শব্দগত রূপ। অন্ধকারের মতো ভারী বলে আখ্যা দিয়েছেন সেই দুঃস্বপ্নকে। কবির ভাষায়- ‘মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়/ মধ্যরাত্রে।/’ বাইরে এসে দেখি/ তারায় ছেয়েছে বর্ণহীন আকাশ/ আর হাওয়া দিয়েছে বিপুল শূন্যতা থেকে/ সে হাওয়ায় শুধু যেন শুনি,/ কান পেতে শুনি,/ কোন সুদূর দিগন্তের কান্না;/ সে কান্না যেন আমার ক্লান্তি,/ আর তোমার চোখের বিষণ অন্ধকার।’ 

তার কবিতার স্থানিক পরিধি কখনো কখনো বৈশি^ক প্রেক্ষাপটকেই ধারণ করেছে। মধ্য এশিয়ার কথা থাকলেও পৃথিবী কথাটি বার বার এসেছে। কবিতার কলেবর ছোট হলেও অনুভূতির কলেবর সীমাকে ছাড়িয়ে গেছে। কবি সমর সেন নিজেকে ভৌগোলিক সীমারেখার পরিবর্তে পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

 

কবি বহুবার বলেছেন তার মনে শান্তি নেই। সমর সেন কবিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দসমষ্টিকে বেদনার রঙের আস্তরণ দিয়েছেন। তিনি এমন বিশেষণ ব্যবহার করেছেন সেখানেই শব্দের অর্থ বদলে গেছে বিষাদের পক্ষে। ‘স্বর্গ হতে বিদায়’ কবিতায় দেখি শহর তার কাছে ধূসর শহর। ‘হে শহর হে ধূসর শহর’ বলে শহরকে সম্বোধন করেছেন

 

‘চার অধ্যায়’ কবিতায় কবি চারটি পর্বের কথা বলেছেন। এই চার পর্বের ঐক্যসূত্র হলো দুঃখবোধ। সর্বত্রই এই ব্যঞ্জনা দীর্ঘতর হয়েছে। চারটি পর্ব পাঠে কবিতাটির একটি দৃশ্যকল্প তৈরি করে নেওয়া যায়। বিচ্ছেদের শিকার কেউ একজন রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার সে রাত। এ রাতের কোনো স্থানিক সীমা নেই। কবি অখন্ড পৃথিবীর কথা বলেছেন। বিষণœ অনুভূতিতে ১ সংখ্যক পর্বে কষ্টের অগাধ গভীরে নিমজ্জিত বিচ্ছেদের শিকার হওয়া ব্যক্তি। ১ সংখ্যক কবিতায় তার স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়- ‘দিন নেই, রাত নেই, বারে বারে চমকে উঠি;/ শুধু মনে পড়ে/ কঠিন অন্ধকারে অবরুদ্ধ বাতাস/ দেয়ালের ওপর বিষণœ ছায়া,/ আর তোমার পাশে/ রাত্রি-জাগরণ-ক্লান্ত আমার দীর্ঘশ্বাস।/ এই অংশে মূলত ব্যক্তির কষ্টে ডুবে থাকার বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়। অতীতের ‘স্পন্দমান’ দিনগুলোকে কবি দুঃস্বপ্ন বলে উল্লেখ করেছেন।

২ সংখ্যক কবিতায় গভীর রাতে বিচ্ছেদের অপর প্রান্তের মানুষকে ভীষণভাবে মনে পড়ার কথা বলা হয়েছে। ‘নীড়হারা পাখির শব্দ নিঃসঙ্গ আকাশে’ চরণের মাধ্যমে সেই কথা কবি তুলে এনেছেন। ৩ সংখ্যক পর্বে এসে কবিতার রহস্য উন্মোচিত হয়। প্রসঙ্গত, ১ ও ২ সংখ্যক পর্বের অর্থময়তা বস্তুনিষ্ঠ হয়ে ওঠে ৩ সংখ্যক পর্বের আলাপনে। এখানে জানা যায়, ‘মিলি’ নামক জনৈক মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। কবি সেই মেয়েকে ভুলতে চাওয়ার আকুলতা সমৃদ্ধ একটি চরিত্রকে আমাদের মুখোমুখি করেছেন। সেই চরিত্রের মনে হয়েছে একজন মানুষকে ভুলে যাওয়া কঠিন কিছু হবে না। শরীরে অপর শরীরের যে স্পর্শ তা কবি মুছে ফেলার চেষ্টার কথা বলেছেন। কবি কল্পনায় অন্ধকারে ‘মিলি’র দাঁত স্পষ্ট দেখতে পান। কবি পরিপাশের্^র বর্ণনা দিয়ে সেখানে গেঁথে দিয়েছেন তাল তাল দুঃখবোধ। সেই বোধ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে যায়, ‘আর বসন্তের কোন রাত্রে/ পদ্মদীঘির জলে যখন ছায়া দীর্ঘ হবে,/ তখন বাসনায় ক্লান্ত দেহ/ তার নিঃসঙ্গ, অদৃশ্য মূর্তি চকিতে আসবে/ নির্মীলিত চোখের অন্ধকারে.../ আর সে রাত্রে পৃথিবীর সমস্ত ঘুমে দুঃস্বপ্ন।’ ৪ সংখ্যক কবিতায় অর্থাৎ শেষাংশে বিচ্ছেদের কথা ভুলতে না পারারই জয় হয়। বোঝা যায় ভুলতে চাইলেই ভোলা যায় না। যত আয়োজনই থাকুক না কেন, ভুলে যাওয়ার যত চেষ্টাই করা হোক না কেন মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।

সমর সেনের কবিতায় যে নগর জীবন আছে তা বিষাদের ছায়াচ্ছন্ন। ব্রিটিশ উপনিবেশের নগরে অধীনতার যন্ত্রণা আছে। নিজ দেশকে কবির কাছে মনে হয়েছে ‘প্রভুহীন’। নিজেদের দেশ অন্যজনেরা শাসন করে, কর্তৃত্ব ফলায়, শোষণ করে, অত্যাচার করে। ভয়াবহ অপশক্তির মতো চেপে বসে থাকা সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দুশ্চিন্তা কবির মন ও মননে বার বার আঘাত করেছে। ফলে কবির মনে নৈঃসঙ্গতা যূথবদ্ধ হয়েছে। ব্যক্তিক জীবন থেকে ব্যক্তি নিরপক্ষে জীবন, কোথাও শান্তি নেই। ফলে কবি বহুবার বলেছেন তার মনে শান্তি নেই। সমর সেন কবিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দসমষ্টিকে বেদনার রঙের আস্তরণ দিয়েছেন। তিনি এমন বিশেষণ ব্যবহার করেছেন সেখানেই শব্দের অর্থ বদলে গেছে বিষাদের পক্ষে। ‘স্বর্গ হতে বিদায়’ কবিতায় দেখি শহর তার কাছে ধূসর শহর। ‘হে শহর হে ধূসর শহর’ বলে শহরকে সম্বোধন করেছেন। কবিতাটির নামকরণের মধ্যে যে ইঙ্গিত তা মূলত নগর জীবন থেকে সুখ তিরোহিত হওয়ার ইঙ্গিত। কবি লিখেছেন- আর এখনো আকাশের মরুভূমিতে/ নিঃসঙ্গ পশুর মতো রাত্রি আসে,/ ট্রাম লাইন শেষ হলে, শেষ হলে ধূসর শহর!/ রাত্রে চাঁদের আলোয় শূন্য মরুভূমি জ¦লে/ বাঘের চোখের মতো।’ কবির কাছে শহরের রূপ ফুটে আছে এ কবিতায়। তিনি আরও লিখেছেন- ‘কালিঘাট ব্রিজের উপরে কখনো কি শুনতে পাও/ লম্পটের পদধ্বনি/ কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও/ হে শহর হে ধূসর শহর!’  ‘নাগরিক’ কবিতায় তিনি বলেছেন- ‘মহানগরীতে এলো বিবর্ণ দিন, তারপর আলকাতরার মতো রাত্রি।’ দিনের চিত্র তিনি আশাব্যঞ্জক দেখতে পাননি। মহানগর যেন যন্ত্রণাময় দিবারাত্রের কাব্য। এই কবিতাতেই তিনি লিখেছেন- ‘ভস্ম অপমান শয্যা ছাড়/ হে মহানগরী!’ সময়ের বিবর্ণ ছাপ মূলত সমর সেনের কবিচিত্তকে আন্দোলিত করেছে, পীড়িত, ব্যথিত করেছে। ফলে তার সময় উৎসারিত কথামালার অন্তপ্রাণ হয়ে উঠেছে সময়ের দগদগে ক্ষত।

সমর সেনের ‘একটি বুদ্ধিজীবী’ কবিতায় পরোক্ষ আশ্রয়ে কবি উপনিবেশের প্রসঙ্গ আনলেও তা সহজেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এ কবিতার পরতে পরতে ব্রিটিশের গন্ধমাখা শব্দ ব্যঞ্জনা। কবির ভাষায়- যাযাবর মেঘ এলো পাহাড়ের বন্দরে,/ আর আমাদের জাহাজের উপর/ সেই গম্ভীর পাহাড় থেকে দুরন্ত ঝড় এলো / শান্তি নেই,/ লোকারণ্যে ঐশ্বর্যের সূর্য ছড়ায় ছায়ার দুঃস্বপ্ন।/ বৃদ্ধ মহাকাল/ ক্ষয়িষ্ণু জীবনে এনেছে জরার যন্ত্রণা।’ শিক্ষিত সমাজের ভূমিকাও আশাজাগানিয়া ছিল না। তাদের ওপরও কবির ছিল বীতশ্রুদ্ধ। কবিতাটিতে কবির চরম উৎকণ্ঠা উঠে এসেছে। সামষ্টিক সমাজের অবনমন এ কবিতার প্রধানতম সুর হিসেবে বেজে ওঠে। কোথাও যেন মুক্তির আলোকশিখা নেই। শিক্ষিতজনদের উদ্দেশ করে লিখেছেন- ‘আমাদের মুক্তি নেই, আমাদের জয়াশা নেই; তাই ধ্বংসের ক্ষয়রোগে শিক্ষিত নপুংসক মন/ সমস্ত ব্যর্থতার মূলে অবিরত খোঁজে/ অতৃপ্তরতি উর্বশীর অভিশাপ।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে ছিল চরম অস্থিরতা। একই সঙ্গে চরমতম অর্থনৈতিক মন্দা মানুষের জীবনে বয়ে এনেছিল ভয়াবহ সংকট। অনেক নারী তখন নিজেদের দেহ দিয়ে শরীর বাঁচানোর পথ বেছে নিয়েছিল। যৌনকর্মী নারীর সংখ্যা বেড়েছিল অনেকগুণ। এক মুঠো খাবারের আশায় গ্রাম থেকে হু হু করে মানুষ শহরের দিকে ছুটেছে। কিন্তু শহরেও খাবারের সুব্যবস্থা ছিল না। কোথাও খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে থাকলে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যেত। সেই উচ্ছিষ্ট নিয়ে টানাটানি কখনো কখনো মানুষে-কুকুরেও হয়েছে। কবি সমর সেন সে কথা তার কবিতায় লিখেছেন। ‘বিরতি’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘উচ্ছিষ্ট নিয়ে ভিখিরী কুকুরে ঝগড়া।’ কবির এ চরণটি রূপক-প্রতীক-ইঙ্গিত-ইশারা নয়। আক্ষরিক অর্থেই সমাজ এই স্তরে নেমে এসেছিল। সঙ্গত কারণে সমর সেনের কবিতার বুননে বিষয় নির্বাচন বারবার হয়ে উঠেছে সমকালের বিচিত্র নেতিবাচক দিক। ক্রিসমাস কবিতাতেও সেই ইশারা পরিলক্ষিত হয়। এখানে সাজানো বাগানে ‘শবাহারী শৃগাল’ বলে যাদের উল্লেখ করেছেন তারা ব্রিটিশ বেনিয়া।

সমর সেন যথাসম্ভব কবিতার অঙ্গশৌষ্ঠব বজায় রেখে কবিতা রচনা করেছেন। অনুভূতি যখন অনিয়ন্ত্রিত হয় কিংবা শিল্প-কাঠামোর চেয়ে যখন বিষয় অধিক মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন কবিতার অঙ্গশৌষ্ঠবের পাশাপাশি বিষয় প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। পরোক্ষ ভাবকাঠামো অনেক সময় তখন পরাহত হয়। গভীরমাত্রায় সচেতন কবি সমর সেনের কবিতাতে তাই কখনো কখনো জ¦লন্ত সমাজ দগদগে শব্দব্যঞ্জনায় ফুটে উঠেছে। ‘ক্রান্তি’ কবিতা তার অনন্য দৃষ্টান্ত। এ কবিতার ৩ সংখ্যক অংশটি উদ্ধৃতিযোগ্য- “রাস্তায় রক্তের দাগে/ মৃতেরা স্মরণ মাগে।/ শীতের সন্ধ্যায় কুয়াশায় ট্যাকসই সংসার ধীরে ধীরে লুপ্তপ্রায়,/ শবলোভী শকুনেরা স্তব্ধতায় উড়ে যায়।/ বাজারে দারুণ ভিড়; দুর্ভিক্ষের করাল ছাপ/ অনেকের মুখে/ ভারতের হৃৎপিন্ডে হানা দেয় বিদেশি বণিক/ পূর্ব সীমান্তে ক্রমশ জমে পীত সৈনিক।” সমর সেন সময়ের সন্তান। তার কবিতা সময়ের প্রতিভূ। সময়কে ভেঙে ভেঙে তিনি সাজয়েছেন কবিতালোক।

কবি সমর সেন ১৮ বছর বয়সেই কবিতা ভুবনে প্রবেশ করেন। আমৃত্যু কবিতা রচনার সঙ্গে থাকলে তিনি দীর্ঘকাল কবিতা লিখতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি মাত্র ১২ বছর কবিতা চর্চা করে তা বন্ধ রেখেছেন। তিনি কিছু গদ্যও লিখেছেন। অনুবাদও কিছু করেছেন। তবে সেগুলো প্রধান নয়। সমর সেনের পরিচয় তিনি একজন শক্তিমান কবি। কবিতাবিষয়ক তার প্রবন্ধগুলো উল্লেখ করার মতো। এই প্রবন্ধগুলো তার কবিতার বিশ্লেষণের জন্য সহায়ক। কবিতা এবং কবিতার ব্যাখ্যা দুটো বিষেøষণ করে যে সমর সেন যে উচ্চতায় উন্নীত হন তা তা অনন্য।

সর্বশেষ খবর